—প্রতীকী চিত্র।
সকাল তখন ১০টা। তিলধারণের জায়গা নেই বিডিও অফিস চত্বরে। ত্রাণের ত্রিপল নেওয়ার লাইন তখন ১০০ মিটার ছাড়িয়ে গিয়েছে। সেই ভিড় ঠেলে কোনও ক্রমে নিজের ঘরে ঢুকছেন বিডিও। ঠিক তখনই তাঁর চোখ আটকে গেল সামনে। দেখলেন, পরনে দামি টি-শার্ট, ট্রাউজ়ার পরিহিত এক যুবককে। তাঁর পায়ে ব্র্যান্ডেড স্নিকার্স। হাতের মুঠোয় লেটেস্ট মডেলের আইফোন। তিনি এসেছেন বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেওয়া ত্রাণের ত্রিপল নিতে! যাই হোক, মাথা নেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন বিডিও। চেয়ারে বসে সামনে থাকা সিসিটিভিতে চোখ রাখতে আবার ঝটকা খেলেন বিডিও সাহেব। দেখলেন, শুধু ওই স্মার্ট যুবকই নন। একটা ত্রিপলের জন্য তখন চার চাকার গাড়িতে ছয়লাপ বিডিও অফিস চত্বর। খোঁজখবর নিয়ে বিডিও জানতে পারলেন, হ্যাঁ, সত্যিই। এঁরা সবাই এসেছেন ত্রিপলের জন্য। মুহূর্তের মধ্যে ত্রিপল বিতরণ স্থগিত করলেন তিনি। গাড়িমালিকদের কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সবাই লজ্জায় লাল। মুহূর্তে পাতলা হয়ে গেল লাইন। বিডিও ঘোষণা করলেন, শুক্রবারের বদলে শনিবার পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ত্রিপল বিতরণের হবে। এমনই সব দৃশ্য দেখা গেল নদিয়ার করিমপুর-২ ব্লক প্রশাসনিক দফতরের সামনে। বিডিও জানাচ্ছেন, তাঁর ওই ঘোষণায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা খানিকটা হয়রানির শিকার হলেন ঠিকই, কিন্তু উপায় ছিল না।
টানা তিন দিনের প্রবল বৃষ্টিতে নদিয়ায় একাধিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক গৃহস্থের গোয়ালঘর ধসেছে। টালির ছাউনি দেওয়া রান্নাঘর ভেঙে পড়েছে। করিমপুর-২ ব্লকে দু’টি মাটির বাড়ি ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। শুক্রবার তাই ত্রিপল বিলি হচ্ছিল বিডিও অফিসের সামনে। তা ছাড়াও বেশ কিছু ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছিল ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক মানুষদের। হিসাব কষে মোট ৬০ জন ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ত্রিপল দেওয়া হচ্ছে— এই খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তার পর ভিড় সামলাতে কার্যত হিমশিম দশা হয় কর্মীদের।
শুক্রবার বেলা যত গড়িয়েছে, তত লম্বা হয়েছে ত্রিপল নেওয়ার লাইন। এত ক্ষতিগ্রস্ত! ত্রিপলের জন্য এই অস্বাভাবিক জমায়েত দেখে অবাকই হন বিডিও শামসুজ্জামান। তিনি জানান, চেম্বারে ঢুকে ভিড় দেখে আবার বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। হাতে আইফোন ধরা এক যুবকের কাছে জানতে চান, ফোনের দাম কত। তাতে লজ্জাবনত দৃষ্টিতে ওই যুবক জবাব বলেন, ‘‘এক লাখ পনেরো হাজার।’’ ত্রিপলের লাইনে দাঁড়ানো লোকজন তখন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। বলে কী! অন্য দিকে, বিডিও-র সঙ্গে যুবকের প্রশ্নোত্তর পর্ব ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে দেখে, একটার পর একটা গাড়ির স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শোনা গেল। দামি মোটরবাইক এবং চার চাকার ভিড় কয়েক মিনিটের মধ্যে হালকা হয়ে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন বিডিও অফিসের কর্মীরা। কিন্তু ওই আইফোনধারী যুবক এবং গাড়িমালিকদের ভিড়েই মিশেছিলেন প্রকৃত ত্রাণপ্রার্থীরা। তাদের হয়রানির জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন বিডিও। তাঁর কথায়, ‘‘কিন্তু, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।’’
করিমপুর ২ ব্লকের বিডিও বলেন, ‘‘এত ভিড় দেখে প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। আমাদের কাছে যা খবর ছিল, তাতে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা ১০০-র আশপাশে হওয়া উচিত। কিন্তু সকাল থেকেই দেখছি মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। সকাল ১০টার মধ্যে দেখলাম কয়েকশো মানুষের ভিড়। সীমিত ত্রাণ নিয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, এঁদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত নয়। তখনই চোখে পড়ল, এক জনের হাতে আইফোন। তাঁকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতেই আপনাআপনি ভিড় পাতলা হয়ে গিয়েছে।’’
ওই আইফোনের মালিককে পাওয়া গিয়েছে পরে। নন্দনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে তাঁর বাড়ি। নাম রমেন বালা। বয়স ৩৫ বছর। ওই যুবকের কথায়, ‘‘সবাই বলল বিডিও অফিস থেকে সাহায্য দিচ্ছে। তাই আমিও এলাম। অত ভেবে তো দেখিনি। কিন্তু বিডিও সাহেব যে ভাবে বললেন, লজ্জায় বাড়ি ফিরতে পারছি না।’’ এই ঘটনা প্রসঙ্গে করিমপুর-২ ব্লকের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ রাজু মল্লিকের সংযোজন, ‘‘আমরা তো ভেবেই কূল পাচ্ছিলাম না, কী করব। এমন সময় বিডিও সাহেব সমস্যার সমাধান করলেন।’’