Tapas Roy

তৃণমূলের বিধায়কের পদে সোমেই ইস্তফা তাপসের? এর পরে কি বিজেপিতে, সে প্রশ্নে যদিও ধোঁয়াশা জারি

তাঁকে উত্তর কলকাতার জেলা সভাপতি পদ থেকে সরানো, রাজ্যের মন্ত্রী না করা, দলে ‘গুরুত্ব’ না-পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ ছিল। তবে বাড়িতে ইডির হানা তাপসকে ‘বেপরোয়া’ করে তুলেছে বলেই অভিমত অনেকের।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৪ ০৯:২৮
বরাহনগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়।

বরাহনগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়। —ফাইল চিত্র।

বিবিধ বিষয়ে দল নিয়ে তাঁর ক্ষোভ ছিল। কখনও কখনও প্রকাশ্যে তা উগরেও দিয়েছেন। কিন্তু এ বার সে সবও ছাপিয়ে যেতে চলেছেন বরাহনগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, সোমবার দুপুরে বিধানসভায় গিয়ে তাপস বিধায়ক পদে ইস্তফা দিতে পারেন। ঘনিষ্ঠমহলে তিনি রবিবারেই জানিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূল আর করবেন না! তৃণমূল আর করা যাচ্ছে না!

Advertisement

রবিবার থেকে দফায় দফায় তৃণমূলের ‘দূত’ তাপসের বাড়িতে গিয়েছেন। রবিবার গিয়েছিলেন মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। সোমবার সকালে যাচ্ছেন রাজ্যের অপর মন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ। এই ‘অনুরোধ’-এর ঢেউয়ের মুখে তাপস তাঁর ইস্তফার সিদ্ধান্তে অনড় থাকবেন কি না, সেটাই দেখার।

যদি অনড় থাকেন, তার পরে কী?

তাপসের ঘনিষ্ঠ সূত্রদের বিশ্বাস করতে গেলে প্রবীণ এই রাজনীতিক বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন। অনেকে একাধিক ধাপ এগিয়ে এমন বলছেন যে, তাপস উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থীও হয়ে যেতে পারেন। যদিও উত্তর কলকাতার জন্য সজল ঘোষের নাম প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। তাপস নিজে কোনও বিষয়েই কোনও মন্তব্য করতে চাননি। সোমবার সকালে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমার যা যা করণীয়, সর্বসমক্ষেই করব। সাংবাদিক বৈঠক ডেকে, সকলকে জানিয়েই করব। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলছি না।’’ আরও একটি কথা তিনি বলেছেন, যা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। তাপসের কথায়, ‘‘আমি সেই বিধায়ক, গত ১৯৯৬ সাল থেকে বিধানসভা থেকে মেডিক্যাল বিল বাবদে একটা পয়সাও তুলিনি! আমি, আমার মা, স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের জন্য এক পয়সাও নিইনি! সেই আমার বাড়িতে ইডি হানা দিল! কেন দিল? কে দেওয়ালেন?’’

সূত্রের খবর, তৃণমূল যে তিনি আর করবেন না, সে বিষয়ে মোটামুটি মনস্থির করেই ফেলেছেন বরাহনগরের বিধায়ক। রবিবার রাতে তাঁর হিতৈষী এবং অনুগামীদের সঙ্গে বাড়িতে ঘরোয়া বৈঠক করেছেন তিনি। তার যা নির্যাস বিভিন্ন সূত্রে মিলেছে, তা বলছে— সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হানা, এই দু’টি বিষয় নিয়ে তৃণমূলের সম্পর্কে ‘মোহভঙ্গ’ হয়েছে তাঁর। দলের অন্দরে তাঁর এক হিতৈষীর কথায়, ‘‘তাপসদার বাড়িতে ইডি তল্লাশি হল ১২ ঘণ্টা ধরে। দল সে বিষয়ে এক বারও মুখ খুলল না! অথচ, শেখ শাহজাহানের বাড়িতে ইডির অভিযান বা ফিরহাদ হাকিমের বাড়িতে তল্লাশির নামে সিবিআই কী ভাবে সব তছনছ করেছে, রান্নাঘরে গিয়ে মশলার কৌটো পর্যন্ত উল্টে দিয়েছে তদন্তকারীরা, সে বিষয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে বিবৃতি দিলেন! একই যাত্রায় এই পৃথক ফল কেন হবে?’’ তাপসের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, ‘‘সোমবার ওই ইডি তল্লাশির ৫২তম দিন। কিন্তু তা-ও দল এবং দলনেত্রী নীরব।’’

সূত্রের খবর, তাপসকে বোঝাতে গত ৪৮ ঘণ্টায় তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব একাধিক বার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রবিবার রাত পর্যন্ত তিনি দল ছাড়ার ব্যাপারে অনড় মনোভাবই দেখিয়েছেন। আগামী ১০ মার্চ, রবিবার তৃণমূলের ‘জনগর্জন সভা’ রয়েছে ব্রিগেডে। এই ধরনের বড় কর্মসূচির আগে তাপসের যে ‘সক্রিয়তা’ অতীতে দেখা গিয়েছে, তা-ও এ বার দেখা যাচ্ছে না।

কলকাতায় আয়োজিত তৃণমূলের যে কোনও বড় সমাবেশের জন্য তাপসকে সাধারণত ‘বড়’ দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিশেষত, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম এবং ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে জেলা থেকে আগত কর্মীরা কোথায়, কী ভাবে থাকবেন, তার দেখভাল করে থাকেন তাপস। ব্রিগেড সমাবেশের জন্যেও তাপসকেই সেই দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। সেই মতো গত কয়েক দিন ধরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগেরও চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাপস ফোন ধরেননি। অতঃপর রবিবার তাঁর বাড়িতে রাজ্যের মন্ত্রী পার্থকে পাঠানো হয়। কিন্তু তাপসকে নড়ানো যায়নি। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন কুণালও। তাতেও ফল হয়নি। তাপস সকলকেই জানিয়ে দেন, তিনি আর তৃণমূল করতে চাইছেন না।

তাপসের মতো অভিজ্ঞ এবং পরিষদীয় রাজনীতিতে প্রবীণ রাজনীতিক লোকসভা ভোটের মুখে তৃণমূল ছেড়ে দিলে তার অভিঘাত যে নেহাত ফেলে দেওয়ার মতো হবে না, সে বিষয়ে দলের ছোটবড় মহল একমত।

গত ১২ জানুয়ারি তাপসের বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়িতে ইডি হানা দিয়েছিল। বেশ কয়েক ঘণ্টা তল্লাশির পর তাপসের বাড়ি থেকে কিছু কাগজপত্র এবং তাঁর মোবাইল ফোনটি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তাঁকে উত্তর কলকাতার জেলা সভাপতি পদ থেকে সরানো, মন্ত্রী না করা, দলে ‘গুরুত্ব’ না-পাওয়া ইত্যাদি নিয়ে তাপসের ‘ক্ষোভ’ ছিল। তবে ইডির হানা তাঁকে ‘বেপরোয়া’ করে তুলেছে বলেই অভিমত অনেকের। দু’দিন আগেই উত্তর কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুদীপে বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তোপ দেগেছেন তাপস। বরাহনগরের বিধায়কের সরাসরি অভিযোগ, সুদীপই তাঁর বাড়িতে ইডিকে ‘ঢুকিয়েছিলেন’।

তাপসের পুত্র বিদেশে থাকেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এখন বড় চাকরি করেন। মেয়েও মেধাবী। তিনি শিক্ষয়িত্রী। তাপসের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, বাড়িতে ইডির হানা নিয়ে তাপসের পুত্রকন্যাকেও পরিচিতমহলে নানাবিধ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। যা পিতা হিসাবে তাঁর কাছে ‘অসম্মানজনক’ বলে মনে করছেন তাপস। পাশাপাশিই তিনি ক্ষুব্ধ দল তাঁর পাশে না-দাঁড়ানোয়।

বামজমানা থেকে মধ্য কলকাতায় কংগ্রেসি রাজনীতিতে উত্থান তাপসের। আশির দশকে সিপিএম নেতা লক্ষ্মী দের সঙ্গে তাপসের সংঘাত রাজ্য রাজনীতির শিরোনামে থাকত। তবে তৃণমূল তৈরির কয়েক বছরের মধ্যেই কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে মমতার দলে যোগ দিয়েছিলেন। তার পর থেকে কখনও দলবদল করেননি। তবে উত্তর কলকাতার রাজনীতিতে সুদীপ-তাপস বরাবরই পরস্পরের বিরোধী। দুজনের আকচাআকচি লেগেই থাকে। তাপস তা গোপনও করেন না। কখনও তিনি সুদীপ সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘ওর জ্ঞান শুনব না! সুদীপ মাঝে তৃণমূল ছেড়ে দিয়ে জোড়া মোমবাতি করত। আমি ওর থেকে বেশি দিন তৃণমূল করছি।’’ কখনও সুদীপকে বলেছেন ‘নন প্রোডাক্টিভ সাদা হাতি’! কয়েক মাস আগে সুদীপের উদ্দেশে তাপস বলেছিলেন, ‘‘আমি জেলখাটা আসামি নই! আমার গায়ে কেউ এক ফোঁটা কালি ছেটাতে পারবে না!’’ নাম না করে তাপস বলতে চেয়েছিলেন রোজ়ভ্যালি মামলায় সুদীপের ভুবনেশ্বরের জেলে বন্দি থাকার কথা। ব্যক্তিগত সততা নিয়ে যে তাপসের শ্লাঘাবোধ ছিল, সেই তাঁর বাড়িতেই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে হানা দিয়েছিল ইডি! তাপসের অভিযোগ, তাঁকে কালিমালিপ্ত করতে সুদীপই বিজেপির সঙ্গে ‘সেটিং’ করে তাঁর বাড়িতে ইডি ঢুকিয়েছিলেন। কারণ, উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। যদিও এ নিয়ে সুদীপ এই দফায় কোনও মন্তব্য করেননি।

২০১১ থেকে টানা তিন বার বরাহনগরের বিধায়ক তাপস। দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিকে মমতা তাঁকে কিছু দিন প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে তাঁকে আর মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। মাঝে এক বার তাঁর মন্ত্রিত্ব পাওয়া নিয়ে জল্পনা শুরু হলেও শেষবেলায় কারও ‘অঙ্গুলিহেলনে’ তা কেঁচে যায়। তাপসের ঘনিষ্ঠেরা মনে করেন, সেই ‘হাতযশ’ ছিল সুদীপেরই। উত্তর কলকাতায় দলের জেলা সভাপতিত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে সুদীপকে সেই পদে আনা হয়েছিল। তাপসকে দেওয়া হয়েছিল দমদমে। তাঁর মতো মধ্য কলকাতায় রাজনীতি-করা নেতাকে বরাহনগরে বিধানসভায় লড়তে পাঠানো নিয়েও তাপসের অনুযোগ কম ছিল না। বিশেষত, যখন সুদীপের ঘরনি নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়কে চৌরঙ্গি আসনে প্রার্থী করা হয়েছে। এই সেদিনও তিনি বলেছেন, ‘‘সোমেন মিত্রের স্ত্রী, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীরা এখানে টিকিট পায়! আর আমাকে পাঠানো হয় বরাহনগরে!’’ সব মিলিয়ে ক্ষোভ ছিলই তাপসের। কিন্তু তা কখনও দল বা বিধায়ক পদ ছাড়ার জায়গায় যায়নি। ইডির হানা এবং তা নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের নীরবতাই তাপসকে দল ছাড়ার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি তাঁর ঘনিষ্ঠদের।

আরও পড়ুন
Advertisement