Medinipur

WB Municipal Election 2022: মেদিনীপুরে হেরিটেজ তালিকায় রয়েছে অনেক কিছু, বাদ পড়েছে শুধু ইতিহাসের সাক্ষী পুরভবন

১৭৮৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুরাতন জেল বা মরাঠা কেল্লা (বর্তমানে ভবঘুরে আবাস) থেকে মেদিনীপুর শহরকে জেলার সদর শহর হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

Advertisement
অরিন্দম ভৌমিক
অরিন্দম ভৌমিক
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:৫৬
 মেদিনীপুর পুরসভা।

মেদিনীপুর পুরসভা। —নিজস্ব চিত্র।

১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের চুক্তি অনুসারে নবাব মীরকাশেম অবিভিক্ত মেদিনীপুর জেলার যে অংশ কোম্পানিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই অংশে কোম্পানির নিজস্ব রেসিডেন্টই ফৌজদারি ও দেওয়ানি মোকদ্দমা দেখতেন। এই রেসিডেন্টরা একাধারে বিচার, শাসন, রাজস্ব আদায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্তা ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর হওয়ার পর ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২১ অগস্ট মেদিনীপুর-সহ প্রতি জেলায় একটি করে দেওয়ানি এবং একটি করে ফৌজদারি আদালত তৈরি করেন। সুপারভাইসারি পোস্টের বদলে চালু হয় 'কালেক্টর' পদের। ১৭৭৪ সালে কালেক্টরের পদ তুলে দিয়ে প্রভিন্সিয়াল কাউন্সিলের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা হয় চাকলাগুলিকে। ১৭৭৭ সালে পুনরায় কালেক্টর পদ চালু করা হয়। ওই পদে প্রথম বসেন জন পিয়ার্স। ১৭৮৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুরাতন জেল বা মরাঠা কেল্লা (বর্তমানে ভবঘুরে আবাস) থেকে মেদিনীপুর শহরকে জেলার সদর শহর হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

এর ৭৩ বছর পরে কর সংগ্রহের প্রয়োজনে তৈরি হয় ‘পুলিশ চৌকিদারি আইন’। এই আইনের ৩১ নম্বর ধারায় শহরের বিশিষ্ট অধিবাসীদের মধ্য থেকে সর্বাধিক পাঁচ জনকে নিয়ে একটি সদর পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠার বিধান তৈরি হয়। ওই পঞ্চায়েতের সদস্য মনোনয়নের ক্ষমতা ও অধিকার অবশ্য ইউরোপীয় জেলাশাসকের হাতে ছিল। সেই বিধান অনুযায়ী মেদিনীপুর শহরে একটি ‘সদর পঞ্চায়েত’ গঠিত হয়েছিল। সদস্যরা ছিলেন, বাবু প্রসন্নচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, বাবু জন্মেঞ্জয় মল্লিক, বাবু ব্রজলাল ভাদুড়ি, মৌলভি দারাসাতুল্লা, মৌলভি খয়রাৎ আলী এবং সভাপতি ছিলেন ম্যাকগিন। ১৮৬৩ সালের ৭ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েতের অধিবেশনে একটি ‘পৌর সমিতি’ (টাউন মিউনিসিপ্যাল কমিটি) প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল।

Advertisement

১৮৬৫ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত অধিবেশনে ছিলেন আগের সভার বাবু প্রসন্নচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, বাবু জন্মেঞ্জয় মল্লিক-সহ নতুন ৩ সদস্য— বাবু রাজনারায়ণ বসু (ঋষি অরবিন্দ ঘোষের মাতামহ), রামনাথ রক্ষিত, পূর্ণচরণ মিত্র। এই সভায় বাবু কালিদাস মাইতির নামে ১ টাকা চৌকিদারি ট্যাক্স এবং ছোট আদালতের জজ বাবু নবীনকৃষ্ণ পালিতের নামে ৪ টাকা ট্যাক্স ধার্য্য করা হয়েছিল। সভার কার্য বিবরণীতে দেখা যায় সেই সময়ে শহরে ৭১ জন কনস্টেবল ও ৪ জন হেড কনস্টেবল নিযুক্ত ছিলেন। শহরে ঘর ছিল ৩,৬০০ টি এবং ট্যাক্স আদায়কারি তহশিলদার ছিলেন মাত্র ৪ জন, তাই আরও ৪ জন তহশিলদার নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

একই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারির সভায় শহরের জলনিকাশি, রাস্তা ইত্যাদি তত্ত্বাবধানের জন্য শহরবাসীর মধ্যে থেকেই প্রতিনিধি নিয়ে একটি বিশেষ সমিতি তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই সমিতিতে জেলাশাসক কর্তৃক মনোনীত এক জন সরকারি কর্মচারীও থাকবেন ঠিক হয়।

এই ভাবেই ১৮৬৫ সালে শুরু হয় মেদিনীপুর পুরসভা এবং সরকার কর্তৃক মনোনীত ১৪ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় প্রথম পুরসমিতি। ক্যাপ্টেন সোয়েন, বেন্টলি, গ্রান্ট, ইয়াডেল, টেরি, মৌলভি খয়রাৎ আলী, মৌলভি দারাসাতুল্লা, মৌলভি মেনাজ উদ্দিন, বাবু রাজনারায়ণ বসু, বাবু জন্মেঞ্জয় মল্লিক, বাবুরাম গোবিন্দ নন্দী, বাবু রমানাথ রক্ষিত, বাবু প্রসন্নচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং চেয়ারম্যান হার্শ্বেল। বেশ কিছু উপসমিতি তৈরি করে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ২৯ মে অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনে হার্শ্বেল ইংরেজি ও বাংলায় নিয়মকানুন পাঠ করে শুনিয়েছিলেন।

১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রস্তাব করা হয় যে, মিউনিসিপ্যাল আইন যাঁরা মানবেন না তাঁদের বিচার করার ক্ষমতা যেন সমিতির হাতে থাকে। ৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত তৃতীয় অধিবেশনে শহরে গাড়ি-ঘোড়ার উপরে কর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৮৬৬ সালের ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত অধিবেশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে গাড়ি-ঘোড়ার জন্য করদাতাদের সংখ্যা ছিল ৫৬ জন। তাদের কাছ থেকে তিন মাসে ২২৭ টাকা আদায় হয়েছিল যা বেশ লাভজনক ছিল। এ ছাড়াও তালিকায় ১৯৭টি গরুরগাড়ি ছিল।

পুরসভার অন্যতম কীর্তি। পানি ট্যাঙ্কি।

পুরসভার অন্যতম কীর্তি। পানি ট্যাঙ্কি। —নিজস্ব চিত্র।

সদস্যদের মধ্যে জন্মেঞ্জয় মল্লিক ও রমানাথ রক্ষিত বহু জনহিতকর কাজ করেছিলেন। ১৮৭০ সালে সিভিল সার্জেন যখন রাস্তা-নালা-নর্দমার দুরাবস্থা এবং পানীয় জলের অভাবের অভিযোগ করেন তখন জমিদার জন্মেঞ্জয়বাবু সম্পূর্ণ নিজের খরচায় পুস্করিণী খননের ব্যবস্থা করেন। ১৮৭৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের অধিবেশনে বাবু নবীনচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের প্রস্তাব অনুযায়ী শহরকে ১০ টি মহল্লায় ভাগ করা হয়।

পুরসভা পরিচালনার যোগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও ১৮৮১ পর্যন্ত ইউরোপীয়রা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান পদ অধিকার করে ছিলেন। কিন্তু চির-বিপ্লবী মেদিনীপুর এই অন্যায় মেনে নেয়নি। ১৮৮২ সালের ৩ জুলাই ইউরোপীয় প্রার্থীকে হারিয়ে প্রথম বাঙালি ভাইস-চেয়ারম্যান হন আইনজীবী বিপিনবিহারী দত্ত (ব্যারিস্টার ক্ষিরোদবিহারী দত্তের দাদা)। ব্যাপারটা এক রকম বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিল ইংরেজ সরকার। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার সম্পর্কে লিখিত প্রস্তাবটির ভাষা ছিল অপমানজনক, ‘Baboo Bipin Behari Dutta was elected Vice-President and expressed his willingness to accept the post on the understanding that he will relinquish here after if he finds he cannot carry on the work." অর্থাৎ তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে বিপিনবিহারী দত্ত কিছু দিনের মধ্যেই বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করবেন। ব্যাপারটা আরA অপমানজনক হয়েছিল যখন চেয়ারম্যান মি. উইলসন অধিবেশনে থাকা সত্ত্বেও নাম সই করলেন না। এমনকি পরের অধিবেশনেও তিনি সই করেননি।

মেদিনীপুর এর যোগ্য জবাব দিয়েছিল এক বার নয় পর পর দু’বার- ১৮৮৪ সালের ১৮ই মার্চ বিপিনবাবুকে আবার ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে এবং ৩০ ডিসেম্বর বিশেষ অধিবেশনে তাঁকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে। বিপিনবাবুই প্রথম শহরকে ৪টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করে আলাদা আলাদা কমিশনার নিযুক্ত করেছিলেন।

নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি বিপিনবাবুর ভাল কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব দেয় সরকার। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হল না, ১৮৮৮ সালের নির্বাচেনে বিপিনবাবু আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। শুধু তাই নয়, ভাইস-চেয়ারম্যান পদেও নির্বাচিত হলেন আইনজীবী বাবু রঘুনাথ দাস। পুরসভার পুরো নিয়ন্ত্রণ পেল মেদিনীপুরবাসী।

১৮৯০ সালে বিপিনবাবুর মৃত্যুর পরে ১৮৯১ সালে চেয়ারম্যান হলেন বাবু রঘুনাথ দাস। ১৮৯৪ সালের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন স্বদেশপ্রেমী ব্যারিস্টার কেবি দত্ত। মেদিনীপুর বোমা মামলায় যিনি সাহস ও কৃতিত্বের সঙ্গে বিপ্লবীদের পক্ষে লড়েছিলেন। এর পরেও বহুবার ইংরেজ সরকার পুরসভা পরিচালনার ভার নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু মেদিনীপুরবাসী ও তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কোনও দিনই তা সফল হতে দেননি।

শিক্ষার প্রসারের জন্য ১৮৯১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরিকল্পিত হার্ডিঞ্জ স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব নেয় পুরসভা। এর পর বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নেয় পুরসভা— মেদিনীপুর কলেজ, কলিজিয়েট স্কুল, অলিগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয় ইত্যাদি। পুরসভার যে সমস্ত সদস্য উন্নতির জন্য ক্লান্তিবিহীন ভাবে কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্ষিতীশচন্দ্র চক্রবর্তী (সদস্য ১৯১৫ থেকে ১৯৩৭), ব্রজেন্দ্রনাথ সিংহ (সদস্য ১৯৩৮ থেকে ১৯৬৫) এবং সত্যরঞ্জন দত্ত (সদস্য ১৯৩১ থেকে ১৯৬৮)। তিনি পাহাড়িপুর বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদক ও নিখিল বঙ্গ পুরসভা সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন।

আর এক উল্লেখযোগ্য নাম হল আইনজীবী কার্তিকচন্দ্র মিত্র। ১৮৮৭ সালে পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। বিদ্যায়, স্বদেশপ্রেমে ও দানে তিনি ছিলেন অন্যতম। শিক্ষার বিস্তারে নিজের খরচে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘টাউন স্কুল’।

উল্লেখ করতে হয় আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ মাইতির নাম। ১৯১২ সাল থেকে ৪ বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই (রাজা নরেন্দ্রলাল খান ও অন্যান্য জমিদারদের আর্থিক সহায়তায়) ১৯২৪ সালে মেদিনীপুরে জলের কল ও বিশাল জলাধার (রাজা নরেন্দ্রলাল খাঁন ওয়াটার ওয়ার্কস) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় একই সময়ে ক্ষিতীশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের কর্মদক্ষতাও উল্লেখযোগ্য।

তবে যার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হবে, তিনি সর্বজনপ্রিয় সমাজসেবী স্বাধীনতা সংগ্রামী বঙ্কিমবিহারী পাল। নাট্যকার, কবি ও অভিনেতা। পুরসভার সদস্য হিসেবে প্রতি দিন, সকালে নিজের ওয়ার্ডের সমস্ত বাসিন্দার বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন, দুঃস্থ অসুস্থকে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন, নিরন্নকে অন্ন দিতেন, এমন চরিত্র বিরল (জন্ম ১৯০৪, মৃত্যু ১৯৮৯)।

কর্মজীবনে যারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন এবং পুরসভার সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাড়ার (চন্দ্রকোনা) বিখ্যাত আইনজীবী কিশোরীপতি রায়। নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খান এবং কুমার দেবেন্দ্রলাল খান। ১৯১২ সালে এই পৌরসভার সদস্য ছিলেন দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।

১৯৩৬ সালে পুরসভার চেয়ারম্যান রায়বাহাদুর শীতলপ্রসাদ ঘোষের উদ্যোগে এই শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বি এল ইলিয়াস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। সেই সময়ে মেদিনীপুরে ট্রাম চালানোর জন্য পাতা হয়েছিল ট্রাম-লাইন।

পুরসভার কর্মচারী সংঘের ব্যাবস্থাপনায় ১৯৪৮ সালে বিদ্যাসাগর স্মৃতি ভবনে নিখিল-বঙ্গ পৌরসভার কর্মচারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে এই পুরসভার চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন ১৯৬৫ সালে নির্বাচিত ভাইস-চেয়ারম্যান রাজকুমার মিশ্র।

পুরসভা অঞ্চলের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬৯,১২৭, শহরের আয়তন ১৮.৬৫ বর্গ কিলোমিটার। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুই। তৈরি হয়েছে পার্ক, মল, ফ্লাইওভার, মাথা তুলেছে বহুতল অ্য়াপার্টমেন্ট। শুধু নতুন নয়, পুরাতন ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে সরকার অনেক ভবনকে হেরিটেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেই হেরিটেজ তালিকা থেকে বাকি রয়ে গিয়েছে এই শহরের উন্নতির অন্যতম কারিগর ১৫৭ বছরের পুরোনো এই পুরসভার ভবনটি।

আরও পড়ুন
Advertisement