মন্দারমণিতে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে শয়ে শয়ে হোটেল। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
যা কিছু ‘নিষিদ্ধ’, মন্দারমণিতে সে সব ‘প্রসিদ্ধ’। ‘অনিয়ম’ যেন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের এই সমুদ্রসৈকতের। তা না হলে ১৪০টি নির্মাণের অস্তিত্ব যখন সেখানে ‘অবৈধ’ স্বীকৃতি পেয়ে প্রশ্নের মুখে, তখন আরও প্রায় ১০০টি হোটেল-লজ মাথা তুলতে পারে মন্দারমণিতে!
বছর কুড়ি আগে মন্দারমণির ছবিটা ছিল অন্য রকম। মন্দারমণি মানেই পর্যটকেরা বুঝতেন, নিরিবিলি এক সমুদ্রসৈকত। যেখানে হাজার হাজার একর জুড়ে শুধুই বালিয়াড়ি। ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায় লাল কাঁকড়া। দিঘায় হট্টগোল-অবসর কাটিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু পর্যটক, যাঁরা হঠাৎ একটু একলা হতে চাইতেন, তাঁরা আসতেন বাদাবন, কেয়াঘাসের জঙ্গলে ঘেরা নিরুপদ্রব, শান্ত মন্দারমণিতে। উপভোগ্য ছিল সাদা বালিতে পা ডুবিয়ে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখা।
কিন্তু সেই মন্দারমণি আর নেই। সেই ধু-ধু বেলাভূমি, বাদাবনও নেই। মন্দারমণিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে শয়ে শয়ে হোটেল। সেগুলিতে সপ্তাহান্তে পর্যটকদের ভিড় কখনও-সখনও দিঘাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে! ব্যবসার সম্ভাবনা যে বিরাট, বুঝতে দেরি করেননি ব্যবসায়ীরা। তাই গত কয়েক বছরে হোটেলের পর হোটেল গজিয়ে উঠছে মন্দারমণিতে। পাল্লা দিয়ে ধ্বংস হয়েছে পরিবেশ। লাল কাঁকড়ার বংশবৃদ্ধি দফারফা। নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে কেয়াঘাসের জঙ্গল। একের পর এক কংক্রিটের টিলা যখন মাথাচাড়া দিচ্ছে, তখনই পরিবেশ আদালতের নির্দেশে অনিশ্চয়তার মধ্যে মন্দারমণির ১৪০টি ‘অবৈধ’ হোটেল। দিঘা এবং কাঁথির অদূরে বেলাভূমিতে গড়ে ওঠা ওই হোটেলগুলির উপর ‘বুলডোজ়ার’ চলবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতর চলছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মন্দারমণিতে জল মাপছেন আরও শ’খানেক হোটেল-লজের মালিক। ওই হোটেলগুলো সবে উঠছে। কোনওটির কাজ প্রায় শেষ। সেগুলির জন্য যদিও প্রশাসন বা আদালতের কোনও নির্দেশ আসেনি। কিন্তু ঝাউয়ের হাওয়ায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে মন্দারমণির বেলাভূমিতে তর তর করে গড়ে উঠছে ওই নির্মাণগুলি। স্থানীয় বাসিন্দা তথা মৎস্যখটির সম্পাদক শ্রীকান্ত দাসদের দাবি, মন্দারমণি লাগোয়া প্রায় ছ’টি মৌজায় এমন নির্মীয়মাণ হোটেল-লজের সংখ্যাটা প্রায় ৫০০। কেবলমাত্র মন্দারমণি সৈকতের কয়েক কিলোমিটার ধরলে সেঞ্চুরি হয়ে যাবে।
যদিও হোটেল মালিকদের দাবি, অনেক হোটেল-লজের কাজ শুরু হয়েছে আগে। কোথাও সংস্কারের কাজ চলছে। কোনওটির হয়তো কাজ শেষের দিকে। কিন্তু নতুন হোটেলের সংখ্যা ১০০ হবে না!
মন্দারমণি দাদনপাত্রবাড় মৎস্যখটির সম্পাদক শ্রীকান্ত দাস স্বীকার করে নিলেন হোটেল শিল্পের প্রসার হয়েছে। তার ফলে মন্দারমণি-সহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছে। এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, এলাকায় বহু মানুষের জীবন এবং জীবিকা এখন হোটেল ব্যবসার উপরেই নির্ভরশীল। তার পরেও থাকছে ‘কিন্তু’। শ্রীকান্তের মতে, ‘‘প্রকৃতির উপর যে ভাবে কোপ পড়েছে তা নিন্দনীয়। এখানে কোনও নিয়ম মানার বালাই নেই!’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সিআরজেড (কোস্টাল রেগুলেটেড জ়োন ম্যানেজমেন্ট অথরিটি) রেগুলেশন মেনে যদি সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা ছেড়ে নিয়ম মেনে হোটেল তৈরি হত, তা হলে এমন বিপর্যয় নেমে আসত না।’’
কী রকম বিপর্যয়?
মৎস্যখটির সম্পাদক জানাচ্ছেন, ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে বেলাভূমির। সমুদ্র ক্রমশ এগিয়ে এসেছে। শ্রীকান্ত বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে প্রায় ২৫০ মিটার এগিয়ে এসেছে সমুদ্রের জল। ভরা কোটালে এখানকার অধিকাংশ হোটেল চত্বর কিন্তু নোনাজলে ডুবে যায়।’’ দূরের জনবসতির দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রৌঢ় বলেন, ‘‘আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম এবং মৎস্যখটির অস্তিত্ব এখন সঙ্কটে।’’
মন্দারমণির স্থানীয় বাসিন্দারাও বলছেন, হোটেলমালিকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সমুদ্রপার বোল্ডার দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হলেও আশপাশের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছে। মন্দারমণিতে আর অবাধে বাদাবন বেড়ে উঠতে পারে না। এখানে অবাধে ওঠে কেবল হোটেল। আর এই আচমকা পরিবর্তন হয়েছে গত দুই থেকে থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। মন্দারমণির সৈকতে যথেচ্ছ ভাবে ছুটে বেড়ায় চারচাকার গাড়ি, দু’চাকার বাইক। মন্দারমণির সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করায় শাশ্বত মিশ্র নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘‘যা কিছু নিষিদ্ধ, সে সব মন্দারমণিতে প্রসিদ্ধ।’’
মন্দারমণিতে হোটেল শিল্প আশীর্বাদ না অভিশাপ, সেই বিতর্কে রাজনীতি আসবেই। এবং এলও। স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ীদের দাবি, মন্দারমণির অধিকাংশ হোটেল নির্মাণ হয়েছে বাম আমলের একেবারে শেষ দিকে। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের থেকে পাওয়া অনুমোদনের ভিত্তিতে হোটেল গড়ে উঠেছে। আইন মানা হয়েছে? প্রশ্ন শুনেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন এক ব্যবসায়ী। তিনি বললেন, ‘‘আলবাত হয়েছে। জমির চরিত্র বদলের পাশাপাশি হোটেল ব্যবসার সমস্ত নিয়মকানুন মেনে হোটেল তৈরি হয়েছে।’’ কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, সিআরজেড আইনের গেরোয় ২০১১ সাল থেকে মন্দারমণি লাগোয়া সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার জমির চরিত্র বদলের কাজ বন্ধ। পঞ্চায়েত থেকেও আর হোটেল তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয় না। এমনকি, সেখান থেকে হোটেল ব্যবসার যাবতীয় অনুমোদন নবীকরণের কাজও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাতে অবশ্য হোটেল তৈরিতে ভাটা পড়েনি। মাত্র ১০ বছর আগে যেখানে হোটেল সংখ্যা ছিল ৭০ থেকে ৮০টি, সেটা এখন কয়েকশো।
মন্দারমণিতে অবৈধ ভাবে হোটেল তৈরির বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছে দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম। সংগঠনের সভাপতি দেবাশিস শ্যামল বলেন, “মন্দারমণি-তথা পূর্ব মেদিনীপুরের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য হোটেল শিল্পের অগ্রগতির প্রয়োজন। কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে সিআরজেড আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এমন লাগামছাড়া উন্নয়ন কেউ চাননি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সিআরজেড রেগুলেশনের দোহাই দিয়ে দাদনপাত্রবাড় পঞ্চায়েত লাগোয়া উত্তর সোনামুই, মন্দারমণি, দাদনপাত্রবাড়, দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুরের মতো মৌজাগুলিতে ২০১৪ সাল থেকে আবাস যোজনায় টাকা পাওয়া উপভোক্তাদের বাড়ি তৈরির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছিল না। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর কয়েক বছর আগে সেই অনুমোদন মিলেছে। কিন্তু ওই একই মৌজাগুলিতে অবলীলায় গড়ে উঠছে মস্ত বড় সব হোটেল।’’ দেবাশিসের প্রশ্ন, “কোস্টাল রেগুলেশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হোটেল তৈরির অনুমোদন দিচ্ছেন কারা? কাদের মদতে হোটেলগুলির নির্মাণে কোনও বাধা দেওয়া হয় না? জবাব খুঁজে পেলে দেখবেন, সমস্যার সমাধান অনেকটা হয়ে গিয়েছে।’’
তবে মন্দারমণি হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশানের সভাপতি মীর মমরেজ আলির দাবি, ‘‘সিআরজেড অনুযায়ী এলাকা চিহ্নিতকরণ না করাই সমস্যার মূল কারণ।’’ তাঁর দাবি, ‘‘নতুন যে শতাধিক নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো অনেক আগে অর্থাৎ বাম আমলে তৈরি হয়েছে। মন্দারমণিতে এমন ১৮০ থেকে ২০০টি হোটেলের কথা আমি জানি। কিন্তু সেগুলোর সব ক’টির কাজ এখনও শেষ হয়নি। ওঁরা হয়তো সেগুলির কথাই বলছেন।’’ মীর এ-ও জানাচ্ছেন, হোটেল ব্যবসা চালানোর আনুষঙ্গিক যেমন, ট্রেড লাইসেন্স থেকে অগ্নি নির্বাপণের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুমোদন আগে পঞ্চায়েত থেকেই পাওয়া যেত। তাই হোটেল ব্যবসা বেড়ে উঠতে সময় লাগেনি। তিনি বলেন, ‘‘বাম আমলে, অর্থাৎ ২০০০ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে প্রচুর হোটেল তৈরির অনুমোদন মিলেছিল।’’
উল্টো দিকে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দু’-তিন বছরের মধ্যে অনেক হোটেল গজিয়ে উঠেছে। সমস্যার পিছনে তাদের হাত বেশি। প্রায় একশো হোটেল তৈরির কাজ এখন শেষের দিকে।