গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
রবিবার রামনবমীতে যাতে কোনও অশান্তি না হয়, সে ব্যাপারে ইতিমধ্যেই প্রশাসনকে সতর্ক করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত তাঁকে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত নজর রাখতে হবে। তেমন কিছু হলে পরিস্থিতি সামালও দিতে হবে। রবিবার রামনবমী। ওই দিন তা সামাল দিয়েই সোমবার চাকরি বাতিল সামলাতে ময়দানে নামছেন মমতা। আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আসরে নামলেও আসলে যে তাঁর উদ্যোগ বিরোধীদের রাজনৈতিক মোকাবিলা, তা নিয়ে শাসকদল ও প্রশাসনে বিশেষ সংশয় নেই।
বৃহস্পতিবার মমতা খোলাখুলিই ঘোষণা করেছেন, তিনি চাকরিহারা শিক্ষকদের পাশে থাকবেন। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা বঞ্চিত, আমি তাঁদের পাশে ছিলাম, আছি থাকব। আর যদি বিজেপি ভাবে, আমায় এ জন্য জেলে পুরবে, তা হলে ওয়েলকাম! যদি আমায় ধরতে পারো, তা হলে ধরে দেখাও।’’ প্রশাসনিক মহলের অনেকের মতে, এই ধরনের পরিস্থিতে বিরোধীরা সরকারকে বিঁধবে, সেটাই দস্তুর। কিন্তু সরকার পাল্টা আগ্রাসী মনোভাব দেখালে বিরোধীরা ঘাড়ে চড়ে বসতে পারে না। সেই মনোভাব থেকেই মমতা পাল্টা আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখিয়েছেন। শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘এই ধরনের রায় বেরোলে দলীয় স্তরে কর্মীদের মনোবল ধাক্কা খায়। নেত্রী হিসাবে মমতা সেটাও রুখে দিতে চেয়েছেন।’’
তবে এটি প্রত্যাশিতই ছিল। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা ভোট। এমনিতেই ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সঙ্গে নিয়ে মমতাকে সেই ভোটে অবতীর্ণ হতে হবে। প্রায় ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের বিষয়টিকে বিরোধীরা ইতিমধ্যেই তাঁকে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। ফলে মমতার কাছেও পাল্টা রাজনৈতিক মোকাবিলা ছাড়া উপায় নেই।
বৃহস্পতিবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা যে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন, সেখানেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে তিনি বলেছেন, ‘‘একটা রাজনীতির কথা বলছি।’’ তার পরেই তিনি বিজেপি এবং সিপিএমকে একই বন্ধনীতে রেখে আক্রমণ করেছেন। রাজনৈতিক মোকাবিলার এটি যদি প্রথম পদক্ষেপ হয়, তা হলে মমতা তাঁর দ্বিতীয় পদক্ষেপটি করতে চলেছেন আগামী সোমবার নেতাজি ইন্ডোরে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘বঞ্চিত’ শিক্ষকদের সংগঠনের ডাকে তিনি সোমবার (৭ এপ্রিল) বেলা সওয়া ১২টার সময়ে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে যাবেন। মমতা বলেন, ‘‘যাঁরা বঞ্চিত শিক্ষক অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছেন, তাঁরা শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন, আমি যাতে তাঁদের কাছে যাই। কথা শুনতে তো কোনও দোষ নেই। আমি তাঁদের কথা শুনতে যাব। এবং বলতে যাব, ধৈর্য হারাবেন না। মানসিক চাপ নেবেন না।’’
যদিও চাকরিহারাদের সকলেই মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থাকার আশ্বাসকে ‘ইতিবাচক’ ভাবে দেখছেন না। তাঁদের একজন অমিতরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো আগেই পাশে থাকতে পারতেন। তা হলে তো এখন এই দিনটা দেখতে হত না। রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি। এখন চিতায় ঢোকার উপক্রম হয়েছে। এখন মুখ্যমন্ত্রী পাশে থাকার কথা বলছেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই আশ্বাসে কতটা সুরাহা হবে আমি জানি না।’’ চাকরি হারানো শিক্ষক রানাঘাটের বাসিন্দা সাগর মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে বারংবার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তখন তিনি বিষয়টি দেখেননি। মুখ্যমন্ত্রী আরও আগে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করলে, সরকার আদালতে সঠিক তথ্য দিলে আমাদের এই অবস্থার মধ্যে পড়তে হত না।’’
অন্য দিকে, ‘যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের’ সদস্য রজত হালদারের বক্তব্য, বৃহস্পতিবার তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে এই মর্মে যে, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান। তবে সোমবার নেতাজি ইন্ডোরে তাঁরা থাকবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে।
হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চ প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেছে। তার অব্যবহিত পরেই নবান্নে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মমতা। সেখানে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ-সহ রাজ্য সরকারের আমলা, আইনজীবীরাও হাজির ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে বৈঠকের পরে সাংবাদিক বৈঠক করেন মমতা। জানান, সোমবারের কর্মসূচিতে তাঁর সঙ্গে যাবেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য এবং মুখ্যসচিব মনোজ পন্থও। সমাজের বিভিন্ন অংশের বিশিষ্টেরাও থাকবেন তাঁর সঙ্গে। অর্থাৎ, মমতা নেতাজি ইন্ডোরে যাবেন ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হিসাবে। কিন্তু তিনি যে তাঁর ‘রাজনৈতিক অবতার’-এই থাকবেন, তা স্পষ্ট তাঁর কথাতেই। কারণ, মমতার রাজনীতির মূল কথাই হল— ‘আমি তোমাদের লোক’। সেই দর্শন থেকেই বৃহস্পতিবার মমতা বলেছেন, ‘‘যাঁদের চাকরি গিয়েছে, তাঁদের অনেকের মা অসুস্থ। অনেকের বাড়ি-গাড়ির ঋণ মেটাতে হয়। তাঁদের বাচ্চারা স্কুলে পড়ে। এই পরিবারগুলির খাদ্য-বাসস্থান যদি অচল হয়, তা হলে বিজেপি-সিপিএমও সচল থাকবে না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘চাকরি তো শুধু ২৫ হাজারের (মুখ্যমন্ত্রী বাংরবার এই সংখ্যাটিই বলেছেন। আদতে যা ২৫,৭৫২) যায়নি! লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই রায় ঘোষণার পরেই বিজেপি, সিপিএম রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনায় নেমে পড়েছে। জেলবন্দি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিধানসভা বেহালা পশ্চিমে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেই মিছিলের ডাক দিয়েছে বামেরা। বিজেপিও সরাসরি এর ‘দায়’ চাপাচ্ছে মমতা সরকারের ঘাড়ে। এক দিকে যেমন এই বিরোধিতা শুরু রয়েছে, তেমনই চাকরি হারানো হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার বিষয়টিও রয়েছে। সেই বিষয়টি নজরে রেখে মমতাও দু’ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চাইছেন। এক দিকে তিনি সংবেদনশীল হয়ে ‘বঞ্চিত’ শিক্ষকদের ডাকে সাড়া দিয়ে নেতাজি ইন্ডোরে যাচ্ছেন। অন্য দিকে, সেই কর্মসূচিতে গিয়ে মমতা বিরোধী দলগুলিকে এই বার্তা দিতে চাইছেন যে, তিনিই সবটা দেখে নেবেন। যা আসলে সার্বিক ভাবে জনমানসের প্রতিও তাঁর ‘বার্তা’।