মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
আরজি কর-কাণ্ডের পরে বুধবার প্রথম বার একই মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শাসকদলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ২৮ অগস্ট সমাবেশ হয় মেয়ো রোডে। বুধবার সেই মঞ্চেই হাজির থাকবেন শাসকদলের দুই সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। আরজি কর-কাণ্ডের আবহে রাজ্যের যে পরিস্থিতি, তাতে মমতা এবং অভিষেক ছাত্র সংগঠনের মঞ্চ থেকে কী সাংগঠনিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক বার্তা দেন, সে দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মহল।
বস্তুত, বুধবার তৃণমূলের ওই কর্মসূচি হতে চলেছে রাজনৈতিক সংঘাতের আবহে। মঙ্গলবার ‘ছাত্র সমাজ’ আহূত ‘নবান্ন অভিযান’ ঘিরে হাওড়া, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় দিনভর পুলিশ এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। তার পরেই বুধবার ১২ ঘণ্টার বাংলা বনধে্র ডাক দিয়েছে বিজেপি। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই বন্ধ ডাকা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘নবান্ন অভিযানে পুলিশি সন্ত্রাসের প্রতিবাদেই এই বন্ধ।’’ জনতার আশঙ্কা, এই আবহে বন্ধ ডেকে যাবতীয় ‘রাজনৈতিক ফয়দা’ তোলার চেষ্টা করবে বিজেপি। বন্ধ ‘সফল’ করাতে তারা রাস্তায় নামবে। পক্ষান্তরে, শাসক তৃণমূল ঘোষণা করেছে, বুধবার কোনও বন্ধ হবে না। প্রশাসনও বন্ধের ‘মোকাবিলা’ করবে। দলীয় কর্মসূচি উপলক্ষে এমনিতেই মধ্য কলকাতায় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের ঢল নামবে। লোকজন আসবেন দূরদূরান্ত থেকেও। উত্তরবঙ্গ থেকে টিএমসিপির কর্মী-সমর্থকেরা কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম এবং ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে। বুধবার তাঁরাও ‘পূর্ণশক্তি’ নিয়ে সমাবেশে যোগ দেবেন। সঙ্গে থাকবেন দক্ষিণবঙ্গের কর্মী-সমর্থকেরাও। বিজেপির ডাকা ১২ ঘণ্টার বন্ধ তৃণমূলের কর্মসূচি আরও ‘সফল’ করাতে এবং ‘রাজনৈতিক শক্তিপ্রদর্শন’ করাতে আরও ‘উৎসাহী’ করবে। ফলে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ এবং বলপ্রয়োগ ও পাল্টা বলপ্রয়োগের সম্ভাবনা এবং আশঙ্কা থাকছে।
প্রসঙ্গত, বুধবারের সভায় তরুণদের ভিড় দেখিয়ে তৃণমূল পাল্টা আখ্যান রচনা করতে চাইছে। দলের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘মঙ্গলবার ছাত্র সমাজের নামে বিজেপির প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ারা জমায়েত করে অশান্তি করেছেন। বুধবার প্রকৃত ছাত্র সমাবেশের ছবি তৈরি করা প্রয়োজন।’’ তৃণমূল সূত্রের খবর, বুধবারের সভায় মহিলা বক্তার আধিক্য থাকতে পারে। এক তরুণ নেতার কথায়, ‘‘আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে ১৪ অগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচিতে সংগঠনের জেলা ও অঞ্চলের নেতৃত্ব স্তরের ছাত্রীরাও শামিল হয়েছিলেন। সেই কারণে বুধবারের সমাবেশেও ছাত্রীদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।’’ সেই জমায়েত বিরোধী বিজেপির ডাকা বাংলা বন্ধের দিন হলে তার গুরুত্ব আরও বাড়বে বইকি।
মমতা সরকারে আসার আগে থেকেই রাজ্যে বন্ধ-ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেছেন। তৃণমূলের নেতারা জানাচ্ছেন, তৃণমূল শেষ বন্ধ ডেকেছিল সম্ভবত ২০০৯ সালে। ফলে বুধবারেও তাঁর নেতৃত্বে প্রশাসন বিজেপির বনধ্ রুখতে রাস্তায় নামবে। সরকারের তরফে মঙ্গলবারেই জানানো হয়েছে, রাজ্য ‘স্বাভাবিক’ থাকবে। গণপরিবহণ ব্যবস্থাও সচল রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্ধের আহ্বানকারীদের বন্ধ-ধর্মঘট নিয়ে আদালতের নির্দেশের কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঘটনাচক্রে, সেই দিনই এক মঞ্চে হাজির হতে চলেছেন নেত্রী এবং সেনাপতি। আরজি কর-কাণ্ডের আগে থেকেই অভিষেক খানিকটা ‘দূরত্ব’ রচনা করেছিলেন প্রশাসনের সঙ্গে। ঘটনার পর থেকে তিনি সমাজমাধ্যমে তিনটি পোস্ট করেছেন। আর এক বার নিজের কেন্দ্রের প্রশাসনিক বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন। অভিষেকের পোস্টগুলির মধ্যে প্রথমটিই ছিল সবচেয়ে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। যেটি তিনি করেছিলেন ১৪ অগস্ট রাতে আরজি কর হাসপাতালে ভাঙচুরের পরে। সেখানে তিনি দ্বর্থ্যহীন ভাষায় জানিয়েছিলেন, আন্দোলনরত চিকিৎসকদের দাবি ‘সঙ্গত’। সরকারের উচিত তাঁদের ‘ন্যূনতম সুরক্ষা’ দেওয়া। সেই মর্মে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সেই রাতেই একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে ফোনে কথা বলেছিলেন তিনি। ওই ঘটনার পরে মমতা দোষীর ফাঁসি চেয়ে কলকাতার রাজপথে মিছিল করলেও অভিষেককে সেখানে দেখা যায়নি। সেই পটভূমিকায় বুধবার দু’জন একই মঞ্চ থেকে কী বার্তা দেন, তা নিয়ে স্বভাবতই তৃণমূল, বিরোধী পক্ষ এবং আমজনতার মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
আরজি করের চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা নিয়ে ‘নাগরিক প্রতিবাদ’ ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতাই একান্ত আলোচনায় মানছেন, আরজি কর-কাণ্ডে যে ভাবে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যে ক্ষোভ প্রতি দিন রাস্তায় আছড়ে পড়ছে, তাতে দলের কর্মীদের মনোবল ধাক্কা খেয়েছে। বিরোধী দলগুলিও রাজনৈতিক ভাবে রাজ্য সরকার এবং শাসক তৃণমূলের উপর ‘চাপ’ তৈরি করতে চাইছে। বুধবার বিজেপির ডাকা বন্ধও তারই অংশ।
এর আগে ২১ জুলাই এক মঞ্চে হাজির ছিলেন মমতা-অভিষেক। তবে ৩৮ দিন আগে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘২১ জুলাইয়ের সমাবেশ ছিল লোকসভার বিজয়োৎসব। কিন্তু এই এক মাসে পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। বুধবারের সমাবেশ সংগঠনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’’