R G Kar Hospital Ransack

আরজি করে তাণ্ডবকারীরা কোথা থেকে এসেছিল এবং তারা কাদের ছায়ায় লালিত-পালিত? খুঁজে দেখছে পুলিশ

এখনও পর্যন্ত পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, যত তাণ্ডবকারীর ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, তারা বেশির ভাগই বেলগাছিয়া বস্তির। ওই এলাকার লোকের কাছে যা ‘বেলবস্তি’ নামে পরিচিত।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২৪ ১৬:১২
R G Kar Hospital Ransack: Arguments and counter arguments about the political identity of the hooligans

মূল ছবি: পিটিআই এবং এএফপি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বুধবার গভীর রাতে আরজি কর হাসপাতালে তাণ্ডব চালিয়েছিল যারা, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? তারা কোথা থেকে এসেছিল? কে ওই দুষ্কৃতীদের পাঠিয়েছিল? তারা কি শাসক তৃণমূলের? না কি বিরোধী সিপিএমের? ঘটনার পর থেকেই দাবি-পাল্টা দাবি শুরু করেছিল শাসক এবং বিরোধী শিবির।

Advertisement

এখনও পর্যন্ত পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, যত তাণ্ডবকারীর ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, তারা বেশির ভাগই বেলগাছিয়া বস্তির। ওই এলাকার লোকের কাছে যা ‘বেলবস্তি’ নামে পরিচিত। পুলিশ সূত্রের খবর, রতনবাবুর ঘাট সংলগ্ন এলাকারও কিছু ছেলে বুধবার রাতের তাণ্ডবে ছিল। সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন দুষ্কৃতী ওই হামলা চালায়। কার্যত পুলিশের সামনেই প্রায় আধ ঘন্টা ধরে হাসপাতালে ওই নির্বিচার হামলা এবং ভাঙচুর চালায় তারা। কিন্তু তারা কাদের আশ্রিত? সিপিএমের যুবনেত্রী তথা কাশীপুরের বাসিন্দা পৌলবী মজুমদার বলেন, ‘‘যাদের দিয়ে তৃণমূল ভোট লুট করায়, তাদের দিয়েই আরজি কর ভাঙচুর করিয়েছে।’’ পাল্টা কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘আমরা বলেছি দল এবং রং না দেখে পুলিশ ব্যবস্থা নিক। আর সিপিএমের মুখে এ সব কথা মানায় না। কারণ, আরজি করের অদূরেই জোড়া খুন করেছিলেন সিপিএমের দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে যখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ ধরতে গিয়েছিল, তখন পুলিশের গাড়ি আটকেছিলেন সিপিএম নেতা রাজদেও গোয়ালা। আমরা তো কাউকে আড়াল করতে চাইছি না।’’

টালা, পাইপাড়া, কাশীপুর, বেলগাছিয়া অঞ্চলে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল নতুন নয়। এক একটি পাড়ায় একাধিক নেতার গোষ্ঠী রয়েছে। সারা বছর সে সব নিয়ে ছুটকোছাটকা অশান্তি লেগেই থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের নেতারাও ঘরোয়া আলোচনায় আরজি করের ঘটনা নিয়ে স্থানীয় সমীকরণের কথা বলছেন। দলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, ‘‘হাসপাতালের রাজনীতিতে অনেক নেতার স্বার্থ জড়িয়ে। কে কার বিরুদ্ধে কী করিয়ে দেবে বলা মুশকিল।’’ ঘটনাচক্রে, আরজি করের রাজনীতিতে তৃণমূলের যাঁরা বহু দিন যাবৎ যুক্ত, তাঁদের মধ্যে অন্যতম দলের চিকিৎসক-নেতা শান্তনু সেন। তিনিই ‘বিবেকের তাড়নায়’ বুধবার দুপুরে বলেছিলেন, তিনি আর দলের মুখপাত্র নন। সন্ধ্যায় বেহালার সভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেউ কেউ বলছেন মুখপাত্রের পদ ছেড়ে দিয়েছি। জেনে রাখুন, আমরা আগেই তাঁদের সরিয়ে দিয়েছি।’’

প্রসঙ্গত, শান্তনু আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরোধী বলেই পরিচিত। বৃহস্পতিবারেও শান্তনু আরজি করে গিয়ে সন্দীপের সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘যাঁর নামে এত অভিযোগ, তাঁকে কেন বুক দিয়ে আগলানো হচ্ছে? আমি সিবিআইকে অনুরোধ করব, দরকারে ওই প্রাক্তন অধ্যক্ষকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করুন। আমরা পরিপূর্ণ তদন্ত চাই।’’ ঘটনাচক্রে, শান্তনুর স্ত্রী কাকলি এলাকার কাউন্সিলর। তৃণমূলের অন্দরের খবর, উত্তর কলকাতার অপর এক কাউন্সিলরের সঙ্গেও শান্তনু সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। আবার তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক সুদীপ্ত রায় তথা আরজি কর হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানের সঙ্গে শান্তনুর দ্বন্দ্বের কথাও উঠছে (শান্তনুকে সরিয়েই সুদীপ্তকে ওই পদে আনা হয়েছিল)। বুধবার রাতের তাণ্ডব সেই গোষ্ঠীলড়াই প্রসূত কি না, তা নিয়েও শাসক শিবিরের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও সুদীপ্ত বলেছেন, ‘‘আমাদের মধ্যে কোনও গোষ্ঠীলড়াই নেই। আর তৃণমূল ওই ঘটনা ঘটালে ডিওয়াইএফআইয়ের ধর্না মঞ্চ কি আস্ত থাকত?’’ পক্ষান্তরে, শান্তনু বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীকে সব খবর ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে না।’’

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, স্থানীয় বিধায়ক তথা কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ রয়েছেন দুষ্কৃতীদের তান্ডবের নেপথ্যে। ওই বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানার জন্য অতীনকে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। মোবাইলে পাঠানো বার্তারও জবাব মেলেনি।

বুধবার মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচিতে শহর-মফস্‌সলে জনস্রোত দেখেছে বাংলা। মূলত আরাজনৈতিক ভাবেই সেই কর্মসূচির আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে লেগে গিয়েছিল রাজনৈতিক রংও। সিপিএমের ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠন তাদের নামেই আরজি করের সামনে জমায়েতের ডাক দিয়েছিল। তাতে কয়েক হাজারের জমায়েতও ছিল। ছাত্র-যুবদের সংহতি জানাতে পৌঁছে গিয়েছিলেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বৃহস্পতিবার সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের ভাগ নিয়ে গন্ডগোল। যারা এত দিন ভাগ পেত না, তারা বুধবার রাতের হাসপাতালে তাণ্ডব করেছে।’’ সুজনের আরও বক্তব্য, ‘‘গত চার-পাঁচ দিনে আমাদের ছেলেমেয়েরা আরজি করের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। তারা কোনও অশান্তিও করেনি। কিন্তু বুধবার রাতে কী এমন হল যে, পুলিশ ব্যারিকেড আলগা করে দিল? আসলে স্থানীয় তৃণমূলের লুম্পেনদের দেখেই পুলিশ ভয়ে জুজু হয়ে গিয়েছিল।’’

এই সব দোষারোপ এবং পাল্টা দোষারোপের মধ্যেই তিনটি সম্ভাবনা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে।

প্রথম

সিপিএমের নেতা-কর্মীদের বক্তব্য, তাঁদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে ‘কলঙ্কিত’ করতেই তৃণমূল লোক ঢুকিয়ে ওই কাজ করেছে। যে সময়ে হাসপাতালের ভিতরে তাণ্ডব চলছে, সেই সময়ে বাইরের জমায়েতে যুবনেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের বক্তৃতার একটি ভিডিয়োও সিপিএম সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে মিনাক্ষীকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘কমরেডস এবং বন্ধুগণ, যারা এখন হাসপাতালে তাণ্ডব করছে, তোড়ফোড় করছে, তারা আমাদের কেউ নয়।’’ সেই ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে বামেদের জমায়েত এক জায়গায় স্থিতিশীল।

দ্বিতীয়

তৃণমূলের নেতাদের পাল্টা যুক্তি, আরজি কর-কাণ্ডে দল এমনিতেই ‘কোণঠাসা’। তা হলে তৃণমূল কেন ছেলে ঢুকিয়ে হাসপাতাল ভাঙচুর করাতে যাবে? হাতে হাতে মোবাইল থাকায় কিছু ঘটলে ছবি যে প্রকাশ্যে আসবে, তা সর্বজনবিদিত। তা হলে কেন তৃণমূল এই কাজ করবে বা করাবে? সিপিএম বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনকে কলুষিত করতে চেয়েছে।

তৃতীয়

একাধিক তৃণমূল নেতা একটি ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। যাতে দেখা যাচ্ছে, বাম ছাত্র-যুবরা ঝান্ডা হাতে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করছে। যা পরে ভেঙেও যায়। তৃণমূলের দাবি, তার পরেই সিপিএমের ছেলেরা ভিতরে ঢুকে ওই তাণ্ডব চালিয়েছে। তবে এই তত্ত্বে একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রশ্নও উঠছে। যে এলাকার বিধায়ক তৃণমূলের, সাংসদ তৃণমূলের, কাউন্সিলর তৃণমূলের— সেখানে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হওয়া সিপিএমের এত ক্ষমতা হল কী করে? তা হলে কি স্থানীয় স্তরে তৃণমূলের মধ্যেই বাঁধন আলগা হয়েছে? না কি বুধবার রাতের ঘটনা টালা এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল?

বস্তুত, তৃতীয় সম্ভাবনাই ক্রমশ জোরালো হতে শুরু করেছে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে। আরজি কর হাসপাতালে ভাঙচুরের ঘটনায় ইতিমধ্যেই ন’জনকে গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশ। তার পর তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘আরজি কর: রাতের ভাঙচুরে গ্রেফতার শুরু। সবকটাকে গ্রেফতার করতে হবে। যে দলের হোক। তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও। যদি কেউ বা কারা স্থানীয় রাজনীতির জন্য বাম-রামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের হাসপাতাল রাজনীতির নোংরা স্বার্থে এসব করায়, তাদের কাউকে ছাড়া যাবে না। বাম-রাম এসব অশান্তি চাইছে।’’ কুণালের পোস্টে স্পষ্ট যে, স্থানীয় রাজনীতির কারণে তৃণমূলেরই কেউ বা কারা ওই কাজ করাতে পারে। যদিও কুণাল এ-ও বলেছেন ‘রাম-বাম’ বোঝাপড়া করেই সবটা করেছে বা করিয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement