Humanity

ভিক্ষাজীবীদের স্নেহে বাড়ছে ‘কলকাতার যীশু’

অসুস্থ শরীরে ফুটপাতের এক পাশে চাদর বিছিয়ে শুয়েছিলেন সনিয়া দাস। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শিশুটির মায়ের দেখা নেই। নিজেই দস্যিটাকে টেনে এনে শুইয়ে দিলেন মেট্রো স্টেশনের দরজার এক পাশে।

Advertisement
সুরজিৎ সিংহ
শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:৫৭
আশ্রয়: মেট্রো স্টেশনের দরজার কাছে সোমনাথকে ঘিরে (বাঁ দিকে) সনিয়া ও মাম্পি (ডান দিকে)।

আশ্রয়: মেট্রো স্টেশনের দরজার কাছে সোমনাথকে ঘিরে (বাঁ দিকে) সনিয়া ও মাম্পি (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

বছর দুয়েকের দস্যিটাকে নিয়ে বৃদ্ধা সন্ধ্যা ঘোষ নাকানিচোবানি খাচ্ছিলেন। ব্যাগে ভরে রেখেছিলেন কিছুটা পচন ধরা আপেল। দস্যিটার নজরে যেতেই ব্যাগ থেকে বার করে বসাল কামড়। বৃদ্ধা চোখ পাকাতেই এক মুঠো ধুলো ব্যাগে ভরে খিলখিল করে হেসে ওঠে একরত্তি। মুহূর্তে বৃদ্ধার রাগ গলে জল।

Advertisement

অসুস্থ শরীরে ফুটপাতের এক পাশে চাদর বিছিয়ে শুয়েছিলেন সনিয়া দাস। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শিশুটির মায়ের দেখা নেই। নিজেই দস্যিটাকে টেনে এনে শুইয়ে দিলেন মেট্রো স্টেশনের দরজার এক পাশে। বিছিয়ে দিলেন কম্বল। খুদের শরীর মুড়ে দিলেন আর একটা কম্বলে। তার পরে গুনগুন সুর করে কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে লাগলেন।কে বলবে, ওঁদের সঙ্গে দু’বছরের শিশুটির রক্তের সম্পর্ক নেই, নেই কোনও আত্মীয়তার বন্ধন। তবু তাঁদের ভরসাতেই রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনের ৬ নম্বর গেটের বাইরে নিজের দু’বছরের ছেলে সোমনাথকে রেখে দিয়ে নিশ্চিন্তে অন্যত্র ভিক্ষা করতে বা কাজে যান মা মাম্পি মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে আরও চার জন এখানে ভিক্ষা করেন। আমি না থাকলে ওঁরাই ছেলেটার যত্নআত্তি করেন। আমিও নিশ্চিন্ত।’’

সনিয়া জানান, সন্তানের জন্মের পর থেকেই স্বামী মাম্পির খোঁজ নেন না। তাই সোমনাথ অসুস্থ হলে তিনি মাম্পির সঙ্গে হাসপাতালে যান। প্রয়োজনে ওষুধ কিনতে টাকা গুঁজে দেন মাম্পির হাতে। বলেন, ‘‘ভিক্ষা করে কী বা আয় হয়! কিন্তু টাকার অভাবে ছেলেটা ওষুধ-খাবার পাবে না, তা কী করে হয়? ছেলেটা খিদেয় কেঁদে উঠলে নিজেদের জন্য রাখা কেক, বিস্কুট ওর মুখে তুলে দিই।’’ মেট্রোর দরজার সামনে কাপড়ের দড়িতে বাঁধা শিশুটিকে দেখে অনেকেই প্রশ্ন করেন। বৃদ্ধা সন্ধ্যা বলেন, ‘‘ছেলেটা এখন হাঁটতে শিখেছে। সামনে রাস্তায় কত গাড়ি ছুটছে। চোখের আড়াল হলেই বিপদ। তাই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।’’

ওঁদের অনেকের এক সময়ে পরিবার, পরিজন থাকলেও মাম্পির মতোই তাঁরা নানা কারণে সে সব বন্ধন হারিয়েছেন। তবে ভবানী সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতে ঘুমিয়ে ও মেট্রোর গেটে ভিক্ষা করে দিন কাটানো মানুষগুলো যেন এক অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়েছেন। সেই বাঁধনের নাম সোমনাথ।

মাম্পি বলেন, ‘‘বড় ছেলেটার যখন দেড় মাস বয়স, তখন ভোরে কেউ কোলের কাছ থেকে ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তবে সোমনাথকে আর ছাড়ব না। ক’টা বছর যাক, ওকে স্কুলে ভর্তি করে দেব। ওকে ঘিরেই আমার সব আশা।’’

Advertisement
আরও পড়ুন