সৈন্যশক্তির নিরিখে বিশ্বের কোন দেশ কতটা শক্তিশালী, ইতিমধ্যেই সেই তালিকা প্রকাশ করেছে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’। এর পাশাপাশি এশিয়ার দেশগুলির ফৌজি র্যাঙ্কিংও তুলে ধরেছে সংশ্লিষ্ট সমীক্ষক সংস্থা। সেখানে জায়গা পেয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাদেশের ৪৫টি রাষ্ট্র। তালিকায় উপরের দিকেই স্থান পেয়েছে ভারত। পাকিস্তানের স্থান বেশ খানিকটা নীচে হলেও নয়াদিল্লির উপরে রয়েছে চিন।
সম্প্রতি ‘এশিয়ান মিলিটারি স্ট্রেন্থ, ২০২৫’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’। সেখানেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাদেশের ৪৫টি রাষ্ট্রের ফৌজি র্যাঙ্কিং। মোট ৬০টি আলাদা আলাদা বিষয়কে বিচার-বিশ্লেষণ করে এই তালিকা তৈরি করেছেন সমীক্ষকেরা। র্যাঙ্কিংয়ের সেরা সূচক স্থির করা হয়েছে শূন্যকে। অর্থাৎ, যে দেশ শূন্যের যত কাছে নম্বর পাবে, তাদের সামরিক শক্তি তত ভাল বলে ধরা হবে।
সৈন্যশক্তির দিক থেকে র্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সামরিক বাজেট। এ ছাড়া কোন দেশের কাছে কী কী অত্যাধুনিক হাতিয়ার রয়েছে, তালিকা তৈরির সময়ে সেটিও খতিয়ে দেখেছেন সমীক্ষকেরা। সৈনিকদের সংখ্যা, নৌবহর এবং বিমানবাহিনীর ক্ষমতার নিরিখে রিপোর্ট তৈরি করেছেন তাঁরা।
‘এশিয়ান মিলিটারি স্ট্রেন্থ’ প্রতিবেদনে প্রথম স্থান পেয়েছে রাশিয়া। সমীক্ষকেরা মস্কোকে দিয়েছে ০.০৭৮৮ নম্বর। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাতে। সেই সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজারের আশপাশে বলে জানা গিয়েছে। সারা বিশ্বের সৈন্যশক্তির নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ‘সুপার পাওয়ার’ এই দেশ।
বিশ্লেষকদের দাবি, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ ফৌজের সুনাম কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। মস্কো খুব দ্রুত কিভের পতন ঘটাতে পারবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এই সংঘর্ষে আন্তর্মহাদেশীয় হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘ওরেশনিক’ ব্যবহার করেছে ক্রেমলিন। মারণাস্ত্রটি শব্দের প্রায় ১০ গুণ গতিতে ছুটে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে সক্ষম। ফলে এশিয়ার তালিকায় এক নম্বর স্থান পেতে রাশিয়ার খুব একটা অসুবিধা হয়নি।
এশিয়ান র্যাঙ্কিংয়ে দু’নম্বর স্থানে রয়েছে চিন। পয়েন্টের নিরিখে অবশ্য মস্কোর সমসংখ্যক নম্বর পেয়েছে বেজিং। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’ জানিয়েছে, ড্রাগনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’র (পিএলএ) বর্তমান সৈনিক সংখ্যা ৩১ লক্ষ ৭০ হাজার। শুধু তা-ই নয়, রণতরীর সংখ্যার নিরিখে আমেরিকাকে ছাপিয়ে গিয়েছে চিন। দুনিয়ার বৃহত্তম নৌবহর রয়েছে সেখানকার চেয়ারম্যান তথা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করেছে চিন। যদিও মস্কো ও বেজিংয়ের মধ্যেও সীমান্ত সংঘাত রয়েছে। গত কয়েক বছরে ড্রাগনের ফৌজিশক্তি বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকার আগে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান আকাশে উড়িয়েছে পিপল্স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) বায়ুসেনা। পাশাপাশি শক্তিশালী ড্রোন এবং রকেটবাহিনীও রয়েছে বেজিংয়ের। আফ্রিকা, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকায় একাধিক সেনাঘাঁটি রয়েছে চিনা লালফৌজের।
এই তালিকায় ভারত রয়েছে তৃতীয় স্থানে। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’-এর সমীক্ষকেরা নয়াদিল্লিকে দিয়েছেন ০.১১৮৪ পয়েন্ট। তিন বাহিনী মিলিয়ে এ দেশের মোট সৈন্যসংখ্যা ৫১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫৫০। এর মধ্যে শুধু স্থলবাহিনীতেই রয়েছেন প্রায় ১২ লক্ষ সৈনিক। প্রসঙ্গত, বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে ভারত ও চিন রয়েছে যথাক্রমে তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে।
২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে প্রতিরক্ষা খাতে ৬ লক্ষ ২১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে কেন্দ্র। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরের এটি ছিল ৫ লক্ষ ৯৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) ১.৮৯ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। আসন্ন অর্থবর্ষে (পড়ুন ২০২৫-’২৬) এই অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাবে বলে ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘরের মাটিতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণে জোর দিয়েছে কেন্দ্র। ‘হাইপারসোনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা করেছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। এ ছাড়া অত্যাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তিতেও উন্নতি লক্ষ করা গিয়েছে। ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় শক্তি বৃদ্ধি করতে একের পর এক রণতরী এবং ডুবোজাহাজ নৌবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি সবাইকে চমকে দিয়ে গত দু’বছরে পরমাণু অস্ত্রের সম্ভারও বাড়িয়েছে ভারত।
এশিয়ার তালিকায় চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং তুরস্ক। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই তিনটি দেশই পরমাণু শক্তিধর নয়। গত কয়েক বছর ধরেই উত্তর কোরিয়া এবং চিনা আগ্রাসনের আতঙ্কে ভুগছে সিওল ও টোকিয়ো। ফলে এক লাফে সামরিক ব্যয় বরাদ্দ অনেকটা বাড়িয়েছে এই দুই দেশ। অন্য দিকে ড্রোনশক্তির নিরিখে বিশ্বে আলাদা পরিচিতি তৈরি করেছে তুরস্ক।
বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের স্থান ১২। তবে এশিয়ার তালিকায় ইসলামাবাদ রয়েছে সপ্তম স্থানে। পরমাণু শক্তিধর ভারতের পশ্চিম পারের প্রতিবেশীটিকে ০.২৫১৩ নম্বর দিয়েছেন সমীক্ষকেরা। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) থেকে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের সঙ্গে চলা সীমান্ত সংঘর্ষ পাক সেনার র্যাঙ্কিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে জানিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। একটা সময়ে বিশ্ব তালিকায় সাত বা আট নম্বরে ছিল ইসলামাবাদ।
এই তালিকায় পাকিস্তানের পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে আরও কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকেরা। এর মধ্যে অন্যতম হল ইসলামাবাদের আর্থিক দুরবস্থা। প্রায় দেউলিয়া হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতের পশ্চিম পারের প্রতিবেশী। এ ছাড়া হাতিয়ারের ব্যাপারে অত্যধিক চিনা নির্ভরতা রয়েছে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের।
তালিকায় অষ্টম স্থান পেয়েছে ইন্দোনেশিয়া। নয় ও ১০ নম্বর রয়েছে দুই চিরশত্রু ইজ়রায়েল এবং ইরান। এর মধ্যে ইহুদি দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে পরমাণু হাতিয়ার। আর পারস্য উপসাগরের তীরের শিয়া মুলুকটি আণবিক অস্ত্র তৈরির খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে বলে স্পষ্ট করেছে আমেরিকার গুপ্তচর বাহিনী।
‘এশিয়ান মিলিটারি স্ট্রেন্থ’-এর রিপোর্টে, চিনের সঙ্গে প্রবল সংঘাত চলা তাইওয়ান রয়েছে ১১ নম্বর স্থানে। পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়া পেয়েছে ১৬তম স্থান। ১৭ এবং ১৮ নম্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে যথাক্রমে বাংলাদেশ এবং মায়ানমার। পশ্চিম এশিয়ার এককালের শক্তিধর ইরাক জায়গা পেয়েছে ২১ নম্বরে।
এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম শক্তিধর দেশ হল ভুটান। তালিকায় এর ঠিক উপরেই রয়েছে হিমালয়ের কোলের আর একটি দেশ নেপাল। শেষের দিক থেকে তিন নম্বরে জায়গা পেয়েছে আফগানিস্তান।
বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের নিরিখে অবশ্য এক নম্বর স্থানটি ধরে রেখেছে আমেরিকা। ২০০৫ সাল থেকে চলা ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারে’র তালিকায় এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছে নেই অন্য কোনও দেশ। পাওয়ার ইনডেক্স ২০২৫-এ ওয়াশিংটনের প্রাপ্ত পয়েন্ট ০.০৭৪৪।
সমীক্ষকদের দাবি, আমেরিকার হাতে রয়েছে ২১ লক্ষ ২৭ হাজার ৫০০ সৈনিকের এক বিশাল বাহিনী। দেশের বাইরে অন্তত ১০০টি সেনাঘাঁটি রয়েছে ওয়াশিংটনের। সেখান থেকে বিশ্বের যে কোনও জায়গায় আক্রমণ শানানোর ক্ষমতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ৭৫ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে আটলান্টিকের পারের এই ‘সুপার পাওয়ার’।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম জানিয়েছে, বিশ্ব জুড়ে বেড়েছে নিরাপত্তাহীনতা। এর ফলে ভূরাজনৈতিক সংঘাতের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) প্রায় ৬০টি সশস্ত্র সংঘর্ষের ঘটনা রেকর্ড করেছে এই আন্তর্জাতিক সংগঠন। এটি এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ফোরামের গবেষকদের দাবি, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের মধ্যে যুদ্ধের জেরে নিরীহ নাগরিকদের প্রাণহানির সংখ্যা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি বেশি পরিমাণে রক্তাক্ত হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।