Bengal SSC recruitment Verdict

চাকরি বাতিল মামলা: ডাল মে কালা হ্যায়, ইয়া সব কুছ কালা হ্যায়! মন্তব্য সন্দিগ্ধ প্রধান বিচারপতি খন্নার

এসএসসির প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি বাতিলের মামলার শুনানি চলছে সুপ্রিম কোর্টে। সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চে শুরু হয়েছে শুনানি।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৪৪
সুপ্রিম কোর্টে এসএসসির চাকরি বাতিল মামলার শুনানি।

সুপ্রিম কোর্টে এসএসসির চাকরি বাতিল মামলার শুনানি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

এসএসসির প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি বাতিলের মামলার শুনানি শুরু হল সুপ্রিম কোর্টে। সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চে শুরু হয়েছে শুনানি। রাজ্যের হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদী। কলকাতা হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে ২০১৬ সালের পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়াই বাতিল করা হবে, না কি যোগ্য এব‌ং অযোগ্য চাকরিপ্রাপকদের আলাদা করার নির্দেশ দেবে শীর্ষ আদালত, তা জানতে উদ্‌গ্রীব সকলেই।

Advertisement

শুনানিতে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, “নম্বর কারচুপি হয়েছে। লিখিত পরীক্ষার নম্বর বৃদ্ধি করা হয়েছে।” তার পরেই তিনি রাজ্যের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বাছাই করতে রাজ্যের সম্মতি রয়েছে কি না। রাজ্যের আইনজীবী জানান, যোগ্য এবং অযোগ্য বাছাইয়ে তাঁদের সমর্থন রয়েছে। নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর সংযোজন, তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এই বিষয়ে আলাদা আলাদা তথ্য দিয়েছে।

এসএসসির আইনজীবী আদালতে জানান, নিয়োগ তালিকায় থাকা যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রাপকদের বাছাই করা সম্ভব? তার পরেই এসএসসির উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, “আমাকে বোঝান কেন হাই কোর্ট বলল (যোগ্য-অযোগ্য) আলাদা করা সম্ভব নয়?”

নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে নেমে বেশ কিছু ওএমআর শিট (উত্তরপত্র) উদ্ধার করেছিলেন সিবিআই আধিকারিকেরা। তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন চাকরিচ্যুতদের আইনজীবী। তিনি সওয়াল করেন, ওই সমস্ত ওএমআর শিটের বৈদ্যুতিন তথ্যের ৬৫বি এভিডেন্স আইন অনুযায়ী যাচাই করার কোনও শংসাপত্রও নেই। বৃহস্পতিবারের শুনানিতে অবশ্য এই প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, “৬৫বি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। আসল ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়েছে। ৬৫বি করলে বোঝা সম্ভব হার্ড ডিস্ক থেকে কী ডাউনলোড করা হয়েছে। আর কী আপলোড করা হয়েছিল। এর সঙ্গে প্রমাণের কী সম্পর্ক রয়েছে?” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “৬৫বি করে বোঝা সম্ভব নয় সার্ভারে তথ্য কারচুপি হয়েছে।”

শুনানির একটি পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়েছিল কি না, নষ্ট করলেও তা কত দিনের মধ্যে করার নিয়ম রয়েছে। রাজ্য জানায়, এক বছর পরে ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়। রাজ্য আরও জানায়, ওএমআর শিটের ‘মিরর ইমেজ’ সংরক্ষণ করে রেখেছে এসএসসি। তার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, “সাধারণ ভাবে এটা সঠিক নয়।” একই সঙ্গে রাজ্যের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, “কেউ ওএমআর শিটের মিরর ইমেজ সংরক্ষণ করে রাখেনি। এসএসসি করেনি। তারা দায়িত্ব দিয়েছিল নাইসাকে। তারাও করেনি। নাইসা আবার স্ক্যানটেককে তথ্য দেয়। তারাও সংরক্ষণ করেনি। স্ক্যানটেক স্ক্যান করেই ছেড়ে দিয়েছিল।”

এসএসসিকে দুষে রাজ্যের আইনজীবী বলেন, “কোনও টেন্ডার ছাড়াই নাইসাকে দায়িত্ব দিয়েছিল এসএসসি। তারা কেন এমন করল স্পষ্ট নয়।” প্রধান বিচারপতি বলেন, “অনেক কিছু গোপন করা হয়েছে। একটা জিনিস পরিষ্কার, আসল এবং স্ক্যান ওএমআর শিট একই নয়।”

যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রাপকদের বাছাই করতে মেটা ডেটা খুঁজে বার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। এই প্রসঙ্গে তাঁর সংযোজন, “তা না হলে আমরা যোগ্য এবং অযোগ্য তালিকা বাছাই করতে পারব না।” একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, “সঠিক বিষয় হল এসএসসি মিরর ইমেজ রাখেনি। আসল কপি নেই। প্রমাণ বলতে শুধুমাত্র স্ক্যান কপি রয়েছে। আবার তার সঙ্গে এসএসসি বসানোর নম্বরের থেকে আলাদা। এমনকি স্ক্যানিং অনিয়ম করা হয়েছে।”

বৃহস্পতিবারের শুনানিতে ‘সুপারনিউমেরারি’ পোস্ট নিয়ে সুপ্রিম-প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্য। প্রধান বিচারপতি রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, “অযোগ্যদের খুঁজে বার না-করে সুপারনিউমেরারি পোস্ট তৈরি করলেন। ওই সময় কেন এটা করলেন? আপনারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন অযোগ্যদের বাদ দেওয়া হবে না।” রাজ্যের আইনজীবী বলেন, “ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কোনও নিয়োগ করা হয়নি। হাই কোর্টের অনুমতি ছাড়া নিয়োগ করা যেত না।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “সিবিআই তদন্ত করে নির্দিষ্ট সংখ্যক বেআইনি নিয়োগ পেয়েছে। তা হলে কেন পুরো ২৪ হাজার নিয়োগ বাতিল করা হল? এটা মাথায় রাখা দরকার মূল মামলা দায়ের হয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ২-৩ বছর পরে।”

প্রসঙ্গত, এসএসসিতে নিয়োগ করতে অনেক অতিরিক্ত পদ (সুপারনিউমেরারি পদ) তৈরি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকারই সেই অনুমোদন দিয়েছিল। অভিযোগ, ওই সমস্ত শূন্যপদে অযোগ্যদের নিয়োগ করা হয়েছিল।

এসএসসি-র আইনজীবী শীর্ষ আদালতে বলেন, “২৬ লক্ষ চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিছু নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু পুরো নিয়োগে নয়। ধাপে ধাপে পরীক্ষা হয়েছে। তাই সব ওএমআর শিট সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব ছিল না। ২০২১ সাল পর্যন্ত কোনও অনিয়মের অভিযোগ করা হয়নি।” কিন্তু এসএসসির ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি প্রধান বিচারপতি। তিনি এসএসসির উদ্দেশে বলেন, “অন্যের হাতে তথ্য তুলে দিলেন। নিজেদের হাতে রাখলেন না? কী ভাবে এটা করতে পারলেন? আপনারাও কারচুপি করেছেন। পঙ্কজ বনসল যে কারচুপি করেছে তা জানা গিয়েছে। সমস্যা আপনাদের নিয়ে।” একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, “কোন কোন ওএমআর শিটের তথ্য ক্যাপচার করা হয়েছে? সেটা দেখে দুপুর ২টোর মধ্যে জানান।”

শুনানির একটি পর্বে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আইনজীবী বলেন, “দেশে এমন কোনও রাজ্য নেই, যেখানে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সমস্যা হয়নি। এটাতে উৎসাহ দিচ্ছি না।” তার পরেই বিদ্রুপের সুরে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমি জানি না ডাল মে কালা হ্যায়, ইয়া সব কুচ হি কালা হ্যায়।” যার বাংলা অর্থ, “আমি জানি না এখানে কিছু গন্ডগোল আছে, না কি পুরোটাই গন্ডগোল আছে।” আপাতত শুনানি স্থগিত। বিরতির পর দুপুর ২টোয় ফের শুনানি শুরু হবে।

গত ২২ এপ্রিল স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রায় ঘোষণা করেছিল কলকাতা হাই কোর্ট। হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৬ সালের নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল ঘোষণা করে। তার ফলে চাকরি যায় ২৫,৭৫৩ জনের। যাঁরা মেয়াদ-উত্তীর্ণ প্যানেলে চাকরি পেয়েছিলেন, যাঁরা সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে ১২ শতাংশ হারে সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে বলা হয় ওই চাকরিপ্রাপকদের।

হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল রাজ্য সরকার। পৃথক ভাবে মামলা করে রাজ্যের শিক্ষা দফতর, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। তার পর সুপ্রিম কোর্টে দফায় দফায় মামলা করেন হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরিহারাদের কয়েক জনও। গত ৭ মে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ চাকরি বাতিল মামলায় অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দেয়। এ ক্ষেত্রে সেই সময়কার প্রধান বিচারপতির যুক্তি ছিল, যদি যোগ্য এবং অযোগ্য আলাদা করা সম্ভব হয়, তা হলে গোটা প্যানেল বাতিল করা ন্যায্য হবে না।

তার পর একাধিক বার শীর্ষ আদালতে এই মামলার শুনানি পিছিয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চে মামলাটির শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও ফের তা পিছিয়ে যায়।

গত বৃহস্পতিবারই অবশ্য প্রধান বিচারপতি খন্না জানিয়েছিলেন, আগামী বৃহস্পতিবার মামলাটির শুনানি হবে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা দুটো বিষয় বিবেচনা করব। অহেতুক বিষয়টি নিয়ে জটিলতা বৃদ্ধি করবেন না।’’ কী সেই দু’টি বিষয়, তা-ও জানান দেশের প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, “পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হবে, না কি বেআইনি ভাবে চাকরি পাওয়া প্রার্থীদের বাছাই করে বাতিল করা হবে এই দু’টি মূল বিষয় আদালত বিবেচনা করবে।”

Advertisement
আরও পড়ুন