সুপ্রিম কোর্টে চলছে ২৬ হাজার চাকরি বাতিল মামলার শুনানি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
একাধিক বার পিছিয়ে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার চাকরি বাতিল মামলার শুনানি হয় সুপ্রিম কোর্টে। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে হওয়া এই শুনানিতে শীর্ষ আদালতের একাধিক প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্য, এসএসসি। সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চে শুরু হয় শুনানি। প্রথম দফায় শুনানির পর মাঝে বিরতি হয়। দ্বিতীয় দফায় ফের শুরু হয় শুনানি। সেই শুনানি এখনও চলছে। কলকাতা হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে ২০১৬ সালের পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াই বাতিল করা হবে, না কি যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রাপকদের আলাদা করার নির্দেশ দেবে শীর্ষ আদালত, তা জানতে উদ্গ্রীব সকলেই।
বৃহস্পতিবারের শুনানিতে শীর্ষ আদালত মূলত যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রাপকদের বাছাই করার উপরে জোর দিয়েছে। সম্ভাব্য কোন উপায়ে তা করা যায়, সেই ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছে। তবে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করা না-গেলে পুরো প্যানেল বাতিল বাতিল করতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি বলেন, “যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করা না গেলে পুরো প্যানেল বাতিল বাতিল করতে হবে।” এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে জানুয়ারি মাসে।
যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রাপক
শুনানির শুরুতেই প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না বলেন, ““নম্বর কারচুপি হয়েছে। লিখিত পরীক্ষার নম্বর বৃদ্ধি করা হয়েছে।” তার পরেই তিনি রাজ্যের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বাছাই করতে রাজ্যের সম্মতি রয়েছে কি না। রাজ্যের আইনজীবী জানান, যোগ্য এবং অযোগ্য বাছাইয়ে তাঁদের সমর্থন রয়েছে। নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর সংযোজন, তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এই বিষয়ে আলাদা আলাদা তথ্য দিয়েছে।
এসএসসির আইনজীবী আদালতে জানান, নিয়োগ তালিকায় থাকা যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রাপকদের বাছাই করা সম্ভব। তার পরেই এসএসসির উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, “আমাকে বোঝান, কেন হাই কোর্ট বলল (যোগ্য-অযোগ্য) আলাদা করা সম্ভব নয়?”
রাজ্যকে সুপ্রিম-প্রশ্ন
বৃহস্পতিবারের শুনানিতে ‘সুপারনিউমেরারি’ পোস্ট নিয়ে সুপ্রিম-প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্য। প্রধান বিচারপতি রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, “অযোগ্যদের খুঁজে বার না-করে সুপারনিউমেরারি পোস্ট তৈরি করলেন। ওই সময় কেন এটা করলেন? আপনারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন অযোগ্যদের বাদ দেওয়া হবে না।” রাজ্যের আইনজীবী বলেন, “ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কোনও নিয়োগ করা হয়নি। হাই কোর্টের অনুমতি ছাড়া নিয়োগ করা যেত না।” প্রসঙ্গত, এসএসসিতে নিয়োগ করতে অনেক অতিরিক্ত পদ (সুপারনিউমেরারি পদ) তৈরি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকারই সেই অনুমোদন দিয়েছিল। অভিযোগ, ওই সমস্ত শূন্যপদে অযোগ্যদের নিয়োগ করা হয়েছিল।
প্রশ্নবাণে বিদ্ধ এসএসসি-ও
এসএসসি-র আইনজীবী শীর্ষ আদালতে বলেন, “২৬ লক্ষ চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিছু নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু পুরো নিয়োগে নয়। ধাপে ধাপে পরীক্ষা হয়েছে। তাই সব ওএমআর শিট সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব ছিল না। ২০২১ সাল পর্যন্ত কোনও অনিয়মের অভিযোগ করা হয়নি।” কিন্তু এসএসসির ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি প্রধান বিচারপতি। তিনি এসএসসির উদ্দেশে বলেন, “অন্যের হাতে তথ্য তুলে দিলেন। নিজেদের হাতে রাখলেন না? কী ভাবে এটা করতে পারলেন? আপনারাও কারচুপি করেছেন। পঙ্কজ বনসল যে কারচুপি করেছে তা জানা গিয়েছে। সমস্যা আপনাদের নিয়ে।” একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, “কোন কোন ওএমআর শিটের তথ্য ক্যাপচার করা হয়েছে? সেটা দেখে দুপুর ২টোর মধ্যে জানান।”
প্রসঙ্গ ওএমআর
শুনানির একটি পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়েছিল কি না, নষ্ট করলেও তা কত দিনের মধ্যে করার নিয়ম রয়েছে। রাজ্য জানায়, এক বছর পরে ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়। রাজ্য আরও জানায়, ওএমআর শিটের ‘মিরর ইমেজ’ সংরক্ষণ করে রেখেছে এসএসসি। তার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, “সাধারণ ভাবে এটা সঠিক নয়।” একই সঙ্গে রাজ্যের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, “কেউ ওএমআর শিটের মিরর ইমেজ সংরক্ষণ করে রাখেনি। এসএসসি করেনি। তারা দায়িত্ব দিয়েছিল নাইসাকে। তারাও করেনি। নাইসা আবার স্ক্যানটেককে দায়িত্ব দেয়। তারাও সংরক্ষণ করেনি। স্ক্যানটেক স্ক্যান করেই ছেড়ে দিয়েছিল।”
‘চাবিকাঠি’ মেটা ডেটা
যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রাপকদের বাছাই করতে মেটা ডেটা খুঁজে বার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। এই প্রসঙ্গে তাঁর সংযোজন, “তা না হলে আমরা যোগ্য এবং অযোগ্য তালিকা বাছাই করতে পারব না।” একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, “সঠিক বিষয় হল এসএসসি মিরর ইমেজ রাখেনি। আসল কপি নেই। প্রমাণ বলতে শুধুমাত্র স্ক্যান কপি রয়েছে। আবার তার সঙ্গে এসএসসির বসানো নম্বরের মিল নেই। এমনকি স্ক্যানিং-এ অনিয়ম করা হয়েছে।”
গোপন করা হয়েছে অনেক কিছু
এসএসসিকে দুষে রাজ্যের আইনজীবী বলেন, “কোনও টেন্ডার ছাড়াই নাইসাকে দায়িত্ব দিয়েছিল এসএসসি। তারা কেন এমন করল স্পষ্ট নয়।” প্রধান বিচারপতি বলেন, “অনেক কিছু গোপন করা হয়েছে। একটা জিনিস পরিষ্কার, আসল এবং স্ক্যান ওএমআর শিট একই নয়।”
পাল্টা সওয়াল রাজ্যের
শুনানিতে রাজ্যের আইনজীবী বলেন, “সিবিআই তদন্ত করে নির্দিষ্ট সংখ্যক বেআইনি নিয়োগ পেয়েছে। তা হলে কেন পুরো ২৪ হাজার নিয়োগ বাতিল করা হল? এটা মাথায় রাখা দরকার মূল মামলা দায়ের হয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ২-৩ বছর পরে।”
কী হয়েছিল হাই কোর্টে
গত ২২ এপ্রিল স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রায় ঘোষণা করেছিল কলকাতা হাই কোর্ট। হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল ঘোষণা করে। তার ফলে চাকরি যায় ২৫,৭৫৩ জনের। যাঁরা মেয়াদ-উত্তীর্ণ প্যানেলে চাকরি পেয়েছিলেন, যাঁরা সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে ১২ শতাংশ হারে সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে বলা হয় ওই চাকরিপ্রাপকদের।
সন্দিগ্ধ প্রধান বিচারপতি
শুনানির একটি পর্বে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আইনজীবী বলেন, “দেশে এমন কোনও রাজ্য নেই, যেখানে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সমস্যা হয়নি। তবে এটাতে উৎসাহ দিচ্ছি না।” তার পরেই খানিক সংশয়ের সুরেই প্রধান বিচারপতিকে বলতে শোনা যায়, তিনি জানেন না “ডাল মে কালা হ্যায়, ইয়া সব কুছ হি কালা হ্যায়। (কিছু গন্ডগোল আছে, না কি পুরোটাই গন্ডগোল)।”
পরবর্তী শুনানি কবে
জানুয়ারি মাসে চাকরি বাতিল মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।