প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র তথা আইনজীবী কৌস্তভ বাগচী। ফাইল চিত্র।
রাজনীতিতে বাক্যবন্ধে বিপক্ষকে ধরাশায়ী করার প্রবণতা নতুন নয়। কিন্তু বাক্যবন্ধে রুচির কি অভাব বাড়ছে? রাজনীতির লড়াই হয়ে উঠছে ব্যক্তিগত আক্রমণের আখড়া? সেই প্রশ্ন যেমন উঠছে, তেমনই প্রশ্ন উঠছে বিপক্ষকে ঘায়েল করতে শাসকের হাতে পুলিশ, আইনের মারপ্যাঁচ ব্যবহার কি বেলাগাম হচ্ছে?
উপরের প্রশ্নগুলি সাম্প্রতিক অতীতে বারবার উঠেছে। শনিবার প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র তথা আইনজীবী কৌস্তভ বাগচীর গ্রেফতারের ঘটনা এই সব প্রশ্ন নতুন করে উস্কে দিয়েছে। কৌস্তভ সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর ‘অতীত’ নিয়ে একটি বইয়ের কথা তুলেছিলেন। সেই প্রসঙ্গকে কুরুচিকর বলেছেন সকলেই। তবে অনেকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, কৌস্তভের আগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী উপ-নির্বাচনে পরাজয়ের প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। তাঁদের প্রশ্ন, রাজনীতির লড়াইয়ে সেই প্রসঙ্গের উত্থাপন কি রুচিশীল?
কৌস্তভের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই জনৈক সুমিত সিংহের অভিযোগকে হাতিয়ার করে গভীর রাতে বাড়িতে হানা দিয়েছিল পুলিশ। প্রশ্ন উঠেছে, কথার পরিপ্রেক্ষিতে এমন পুলিশি অভিযান কি আদৌ উচিত? প্রসঙ্গত, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে মন্তব্যের জেরে কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরাকে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করেছিল অসম পুলিশ। তা নিয়ে নানা মহলে প্রতিবাদ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তৃণমূলের এক মুখপাত্রকেও একাধিক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে সময় তৃণমূল সরবে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজশক্তির অপব্যবহারের অভিযোগ তুলেছিল।
কুকথা এবং শক্তির আস্ফালন যে ভাবে বাড়ছে তাতে চিন্তিত সমাজের বিশিষ্টজন থেকে আমজনতা। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘রাজনীতিতে যে ভাষাদূষণ, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং নিম্নরুচির আকচাআকচি চলছে তা আমাদের গভীর ভাবে মর্মাহত ও হতাশ করে। সত্যি বটে, এ হল প্রতিশোধের যুগ। প্রতিপক্ষকে সবক শেখানোই এখন সিনেমায়, সিরিয়ালে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবল জনপ্রিয়। রাজনীতিতেও তারই ছায়া দেখতে পাচ্ছি। যার হাতে যে ক্ষমতা আছে তারই বল্গাহীন প্রয়োগ চলছে। এ প্রবণতা বিপজ্জনক। আমরা শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষরা ব্যাপারটা আর সত্যিই নিতে পারছি না।’’
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘কুকথা ভয়ঙ্কর ভাবে রাজনীতির পরিবেশকে কলুষিত করছে। কিন্তু পাশাপাশি বাক্-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপও খুবই চিন্তার বিষয়। কারও কথা পছন্দ না হলে, তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুন। কিন্তু সরকারি প্রভাব খাটিয়ে এই ভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করা যায় না।’’ বস্তুত, এ রাজ্যে একটি রঙ্গচিত্র ‘ফরওয়ার্ড’ করে প্রথম রাজরোষের শিকার হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। তবে আদালত তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করেছে। তিনি বলছেন, ‘‘রাজনীতি এবং রাজনীতির বাইরেও কুকথা কেউ বলুন, তা কখনও চাই না। কিন্তু পুলিশ দিয়ে গ্রেফতারের ট্র্যাডিশন এই সরকার চালিয়ে যাচ্ছে। আমাকে গ্রেফতারের ১১ বছর পরে গ্রেফতার করা হল কৌস্তুভ বাগচীকে। বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীকেও অন্যায় ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল।’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব যেমন হয় না। তৃণমূলের সরকার আইন মানছে তা-ও হয় না।’’ কথার পাল্টা যে কথাই হতে পারে তা মনে করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘ভাষার উপরেই আমাদের ভরসা রাখা দরকার। ভাষা দিয়েই যথাযথ উত্তর দেওয়া দরকার। মাঝপথে অন্য পদক্ষেপ করা বাঞ্ছনীয় নয়।’’