Abhishek Banerjee

বাইরনকে তৃণমূলে এনে সাগরদিঘিতে হারের ব্যর্থতা মুছলেন অভিষেক, নির্বাচন হলে কী হত, সে প্রশ্ন রইল

সাগরদিঘির হার তৃণমূলকে জোরালো ধাক্কা দিয়েছিল। সাগরদিঘিতে ভোটের আগে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। হারের পরেও সাগরদিঘিতে তিনি জনসংযোগ যাত্রা এবং সভা করেছেন।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৩ ১৮:০২
Abhishek Banerjee with Byron Biswas

সাগরদিঘি আবার ‘খাতায়কলমে’ তৃণমূলের ঝুলিতে চলে এল। একা বিধায়ক হওয়ায় বায়রনের বিরুদ্ধে দলত্যাগবিরোধী আইনও কার্যকর হবে না। —নিজস্ব চিত্র।

তিন মাস আগে প্রায় ২৩ হাজার ভোটে সাগরদিঘিতে হেরেছিল তৃণমূল। যে উপনির্বাচনে একজোট হয়ে প্রার্থী দিয়েছিল বাম-কংগ্রেস। তৃণমূলের তরফে সেই ভোটের মূল দায়িত্ব ছিল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাগরদিঘিতে প্রচারে যাননি। গিয়েছিলেন অভিষেক। ফলে ২০১১ সাল থেকে টানা ১০ বছর দখলে-রাখা সাগরদিঘি হারার ‘দায়’ অনেকটাই এসে পড়েছিল অভিষেকের কাঁধে। সোমবার বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোটে জয়ী বাইরন বিশ্বাসকে তৃণমূলে এনে সেই ব্যর্থতা মুছলেন অভিষেক— এমনই বলছে তৃণমূল শিবির। তবে একইসঙ্গে এমন প্রশ্নও উঠছে যে, ভোট হলে কী হত। বাইরন অবশ্য দাবি করেছেন, ভোট হলে আরও বড় ব্যবধানে জিতবেন। তাঁর কথায়, ‘‘আবার ভোট হলে আবার জিতে প্রমাণ করব যে, এটা কংগ্রেসের ভোটে জয় নয়।’’

বাইরনের দলবদলে অনেকে নীতির প্রশ্নও তুলছেন। অনেকে বলছেন, সাংসদ বা বিধায়ক ভাঙানোর যে অভিযোগ তৃণমূল বিজেপির বিরুদ্ধে করে, সেই অভিযোগেই তারাও এ বার বিদ্ধ হতে পারে।

Advertisement

তবে ইদানীং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমন ঘটনা আকছার হচ্ছে। যাঁরা মনে করেন, গণতন্ত্রে সংখ্যাই আসল, তাঁরা এর মধ্যে ‘নীতিহীনতা’র কিছু দেখছেন না। তাঁদের বক্তব্য, কাউকে তো জোর করে আনা হয়নি। যিনি এসেছেন, তিনি নিজের ইচ্ছায় এসেছেন। তিনি নিজে সে কথা বলেওছেন।

তিন মাস আগে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জিতে একদিকে যেমন বাম-কংগ্রেস জোট ‘সাগরদিঘি মডেল’-এর প্রচার শুরু করেছিল, তেমনই তৃণমূল খানিকটা পিছনে পায়ে চলে গিয়েছিল। সাগরদিঘির ফলাফল রাজ্য রাজনীতিতে কয়েকটি প্রশ্ন তুলে দিয়ে গিয়েছিল। প্রথমত, সংখ্যালঘু ভোট কি তৃণমূলের থেকে সরে গিয়ে বাম-কংগ্রেসে যাচ্ছে? দুই, তৃণমূলের বিরুদ্ধে কি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কাজ করছে?

বাইরনের দলবদলে সেই প্রশ্নের জবাব মিলবে না। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট এবং লোকসভা ভোটে এর কোনও প্রভাব পড়ে কি না, তা নিয়ে কৌতূহল থাকবে। তিন মাস আগে সাগরদিঘি আসন হারিয়েছিল রাজ্যের শাসকদল। তিন মাস পরে সেই জয়ী কংগ্রেস বিধায়ক পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে গিয়ে অভিষেকের হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা নিয়ে নিলেন! ফলে সাগরদিঘি আবার ‘খাতায়কলমে’ তৃণমূলের ঝুলিতে চলে এল। একা বিধায়ক হওয়ায় বায়রনের বিরুদ্ধে দলত্যাগবিরোধী আইনও কার্যকর হবে না। সে দিক দিয়ে বাইরনের দলবদল ‘মসৃণ’ও বটে।

১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা বামেদের দখলে ছিল মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি বিধানসভা। ২০১১ সালে ‘পরিবর্তনের ভোট’-এ সাগরদিঘির জেতে তৃণমূল। সেই থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাগরদিঘির দখল ছিল তৃণমূলেরই হাতে। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তথা সাগরদিঘির বিধায়ক সুব্রত সাহার মৃত্যুর পর বিধায়কশূন্য হয়ে পড়ে ওই কেন্দ্র। ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়। যেখানে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি প্রার্থী করে তৃণমূল ছেড়ে আসা দিলীপ সাহাকে। যিনি ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সাগরদিঘিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হন বাইরন। তিনি জেতেন প্রায় ২৩ হাজার ভোটে।

মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জনেই ওই হারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তুলে আনেন ‘রাম-বাম-হাত’-এর আঁতাতের কথা। মমতা সরাসরিই বলেন, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংদ অধীর চৌধুরী তৃণমূলকে হারাতে বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। যাতে বিজেপির ভোটও বাম-কংগ্রেস প্রার্থীর ঝুলিতে আসে। ঘটনাচক্রে, তার পরে মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদানের ঘটনা ঘটেছে। আর অধীর বলেছেন, পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলকে ধরাশায়ী করে দেবেন।

অধীরের সেই দাবি সুদে-আসলে সোমবার ফিরিয়ে দিয়েছেন অভিষেক। নীচুতলার তৃণমূল থেকে কংগ্রেসে লোকজন নিয়ে আসতে পারেন অধীর। কিন্তু অভিষেক তুলে নিয়েছেন বিধানসভায় কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধিকে। সাগরদিঘি অতএব, আবার তৃণমূলের ‘দখলে’। অধীর অবশ্য পাল্টা বলেছেন, “নির্বাচনে জেতার পর স্বাভাবিক ভাবেই কংগ্রেসের এই একজন প্রতিনিধিকে হয় ভয় দেখানো নয় প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল হয় প্রথমে টাকার অফার করে নয় ডান্ডা দেখায়...। ওর (বাইরন) কাছে হুমকি ফোন যাচ্ছিল। সেই কারণেই ও যোগদান করেছে।”

ঘটনাচক্রে, বিধানসভা উপনির্বাচনের আগে এবং পরেও সাগরদিঘি নিয়ে শাসকশিবিরে সবচেয়ে ‘সক্রিয়’ দেখা গিয়েছে অভিষেককেই। পঞ্চায়েত ভোটের আগে জনসংযোগ যাত্রায় বেরিয়ে তিনি সাগরদিঘি-সহ মুর্শিদাবাদে সভা করেছেন। এবং বিভিন্ন সভায় বারংবারই সাগরদিঘির প্রসঙ্গ এনেছেন। সোমবার যা দেখা গেল, তাতে এটা স্পষ্ট যে, অভিষেক তথা তৃণমূলের সঙ্গে বাইরনের যোগাযোগ আগেই স্থাপিত হয়েছিল। কারণ, অভিষেকের কথায়, ‘‘আমার সঙ্গে ওঁর (বাইরনের) যোগাযোগ হয়েছিল। জনসংযোগ যাত্রায় একাধিক বার ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মযজ্ঞ এবং তৃণমূলের মতাদর্শকে সামনে রেখেই উনি তৃণমূলে যোগ দিলেন।’’ পাশাপাশিই অভিষেক বলেন, ‘‘আমার মনে হয় বাইরন মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইটা করবেন। জাতি, দলমতনির্বিশেষে কাজ করবেন। আগামিদিনে তৃণমূলের সৈনিক হিসাবে কাজ করবেন। রামধনু জোটের সার্বিক ফল শূন্য।’’

অধীরকেও কটাক্ষও করেছেন অভিষেক। তিনি বলেছেন, ‘‘লড়াই ছিল তৃণমূল বনাম বিজেপির। কংগ্রেসের নেতারা সিপিএম-আইএসএফের সঙ্গে জোট করে কাদের সুবিধা করে দিয়েছে? মানুষ দেখেছে। আমাদের নেত্রী ১০ দিন আগে বলেছেন, আমরা জাতীয় স্তরে কংগ্রেসকে সমর্থন করতে পারি। কিন্তু বাংলায় যেখানে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছি, তখন সিপিএম এবং বিজেপির হাত শক্তিশালী করছেন অধীর চৌধুরী। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি বলছেন, কংগ্রেসের সৈনিক হিসাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধেই লড়বেন। তার মানে আপনাদের লড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে নয়। অন্ততপক্ষে বাংলায় নয়। আর বাংলায় যদি আপনারা বিজেপির হাত শক্তিশালী করেন, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতও ২০২৪ সালে শক্তিশালী করছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement