সুকান্তের হাতে রাজ্য দলের ব্যাটন দেওয়ার দিনে। সেপ্টেম্বর, ২০২১। — ফাইল চিত্র।
মঙ্গলবার তো তাঁর রাজ্য সভাপতি হিসাবে এক বছর পূর্তি? সোমবার সন্ধ্যায় সামনাসামনি এমন প্রশ্নের উত্তরে সুকান্ত মজুমদার বলেছিলেন, ‘‘আমার মনে ছিল না। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে সবাই বলতে থাকায় এখন মনে হচ্ছে, দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল! হিসাব মতো আজই (সোমবার) ৩৬৫ দিন পূর্ণ হল।’’ কেমন কাটল একটা বছর? সুকান্তের জবাব, ‘‘সেটা আমি কী করে বলব! আপনারা বলবেন, দলের কর্মীরা বলবেন। তবে আমি নেতৃত্বের দেওয়া গুরুভার উপভোগ করেছি, করছি। সামর্থ্য মতো কর্তব্য পালন করে চলেছি।’’
২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। সে দিনটাও ছিল সোমবার। সন্ধ্যায় দিল্লির বিজেপি সদর দফতর থেকে দু’টি চিঠি এসেছিল বাংলায়। একটি কলকাতার নিউটাউনে বসে পেয়েছিলেন তৎকালীন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। দীর্ঘ সময় রাজ্যের প্রধানের দায়িত্ব পালনের পরে তিনি হয়ে যান সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। আর প্রায় একই সময়ে বালুরঘাটের মাস্টারপাড়ায় বসে ইমেল পেয়েছিলেন ‘বটানি স্যার’ থেকে রাজনীতিক হওয়া সাংসদ সুকান্ত। জেনেছিলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনিই বাংলা বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি।
সুকান্ত বলেছিলেন এবং এখনও বলেন, ‘‘নিশ্চিত না থাকলেও খবরটা আমার কাছে খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, তার কিছু দিন আগে থেকেই সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছিলাম, দিলীপ’দা নাকি আমার নামই তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে সর্বভারতীয় সভাপতির কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। যদিও এ নিয়ে আমি কোনও কৌতূহল প্রকাশ করিনি।’’
সুকান্ত দায়িত্ব পাওয়ার সময় রাজ্য বিজেপির করুণ দশা। নবান্ন দখলের যে আশার বেলুন বিজেপি ফুলিয়েছিল, তা কয়েক মাস আগেই ফুটো হয়ে গিয়েছে। হতাশা দলের সর্বত্র। শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের অভিযোগ তুললেও তার মোকাবিলা করতে পারছে না দল। অন্য দল থেকে আসা একের পর এক নেতা বিজেপি ছাড়ছেন। জেলায় জেলায় কর্মীদের উপরে অত্যাচারের সময় নেতাদের পাশে না পাওয়ার অভিযোগ। সেই সময়ে মাত্র দেড় বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা (২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে রাজনীতিতে আগমন হয়েছিল সুকান্তর) নিয়ে রাজ্য সভাপতির মতো গুরুদায়িত্ব। মেয়াদ শেষের আগেই দিলীপকে সরিয়ে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জানার পরে বালুরঘাট থেকে আনন্দবাজার অনলাইনকে ফোনে বলেছিলেন, ‘‘দল ভরসা রেখেছে। সেই ভরসার সম্মান রক্ষাই আমার প্রধান লক্ষ্য। বিজেপিতে নেতা নন, কর্মীরাই সব। তাঁদের নিয়েই আমি কাজ করব।’’
প্রথমে স্কুলে এবং পরে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা, গবেষণা নিয়েই ছিলেন সুকান্ত। সঙ্গে আরএসএস-এর শাখায় যেতেন নিয়মিত। ২০১৯ সালে সেই সুকান্তই তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষকে হারান। কিন্তু সে ভাবে রাজ্য রাজনীতিতে তাঁর পরিচিতি ছিল না। তবে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এসে তিনি নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন বলে মনে করে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। স্বল্পবাক সুকান্ত নিজের সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে না চাইলেও তাঁর অনুগামীরা বলেন, ‘‘শিক্ষিত, ভদ্র পরিচয়টাই দাদার সম্বল। তবে তিনি যে কর্মীদের উপরে আঘাত এলে অন্য মূর্তি ধরতে জানেন, তা বার বার দেখিয়ে দিয়েছেন। বিজেপি নেতা-নির্ভর দল না হলেও তিনি নিজেকে নেতা বানিয়ে ফেলেছেন বছর ঘোরার আগেই।’’
গেরুয়া শিবির মনে করে, ‘নেতা’ হয়ে ওঠার প্রথম পরিচয় সুকান্ত দেখিয়েছিলেন গত ১২ জুন। তার কয়েক দিন আগেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা রাজ্য সফরে এসে দলকে পথে নামার নিদান দিয়ে গিয়েছিলেন। বিজেপির সাসপেন্ড হওয়া নেত্রী নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্য এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তখন অগ্নিগর্ভ ছিল হাওড়ার বেশ কিছু অঞ্চল। রাজ্য বিজেপি অভিযোগ তোলে, উলুবেড়িয়ার মনসাতলায় দলের কার্যালয় পুড়িয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। এর পরেই সুকান্ত উলুবেড়িয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তবে তা প্রকাশ্যে আনেন ১১ জুন বেশি রাতে। পরের দিন রাজ্য প্রশাসনকে তাঁর কর্মসূচির কথা জানিয়ে দেন তিনি। তত ক্ষণে হাওড়ায় উত্তেজনাপ্রবণ এলাকাগুলিতে ১৪৪ ধারা জারি করে দিয়েছে প্রশাসন। সুকান্ত-ঘনিষ্ঠরা বলছেন, উলুবেড়িয়া যাওয়ার অনুমতি পাবেন না বুঝেও প্রশাসনকে তা জানান সুকান্ত। লক্ষ্য ছিল, পুলিশের বাধাকে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসা। সেই কৌশলে তিনি যে সফল তা দিনের শেষে স্পষ্ট। পুলিশ বনাম সুকান্তর দিনভর দ্বন্দ্বই তাঁকে শিরোনামে রেখে দেয় সে দিন। সকাল সাড়ে ১০টা থেকেই নিউটাউনের বাড়িতে পুলিশের সঙ্গে সুকান্ত মজুমদারের সংঘাত শুরু হয়ে যায়। তার পর নাটকের পর নাটক। শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময়ে লালবাজারের লক আপ থেকে বার হলেন। তাঁকে ঘিরে তখন কর্মী-সমর্থকদের বিপুল উল্লাস আর স্লোগান। ‘সুকান্ত মজুমদার জিন্দাবাদ’ ধ্বনির সঙ্গে রাজ্য সভাপতিকে রজনীগন্ধার মালায় বরণ করে নেওয়া হয়। বীরদর্পে গাড়িতে যখন উঠছেন তখনই এক বিজেপি নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘‘সুকান্ত’দা আজ সত্যি সত্যি নেতা হলেন।’’
এর পরের নেতার চেহারায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর। তাঁর আমলের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি ছিল ‘নবান্ন অভিযান’। গ্রেফতার করা হতে পারে জেনেও সড়কপথে সাঁতরাগাছি যেতে চান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শুরুতেই গ্রেফতার হয়ে যান। দলীয় দফতর থেকে কর্মীদের নিয়ে বের হয়ে মিছিলে যোগ দেন দিলীপ। সেই মিছিল আটকে যায় হাওড়া ব্রিজে ওঠার আগেই। সঙ্গে সঙ্গেই ‘অভিযান শেষ’ ঘোষণা করে দেন দিলীপ। সুকান্ত তখনও পথে বসে। পরিকল্পনা মতো আগের রাতটা হাওড়া স্টেশনে গোপনে কাটান তিনি। গোলমাল যে হতে পারে এবং হলে তিনি যে এলাকা ছাড়বেন না তা বুঝিয়ে শুরুতেই মাথায় পরে নেন হেলমেট। একটা সময় দেখা যায়, পুলিশের ব্যারিকেড টপকানোর চেষ্টা করছেন তিনি। শেষে অবশ্য জলকামানের সামনে হেরে যান। কিন্তু পথ ছাড়েননি। পথেই বসে যান। রীতিমতো জোর করেই তাঁকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। রাত ৯টা পর্যন্ত গ্রেফতার হয়ে থাকেন। সব কর্মীর মুক্তি পর্যন্ত তাঁকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
এই এক বছর সময়ে বিতর্কেও জড়িয়েছেন। এমনিতে মৃদুভাষী হলেও পুরুলিয়ার একটি সভায় ঝাঁজ শোনা যায় সুকান্তের গলায়। বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূলের পাশে পুলিশ না থাকলে ১৫ মিনিটে ওদের ঘরে ঢুকিয়ে দেব!’’ তবে সবচেয়ে বড় বিতর্কটা হয়েছিল পূর্বসূরি দিলীপের মন্তব্য ঘিরে। সুকান্ত এসেই দিলীপ-ঘনিষ্ঠ অনেককে বাদ দিয়ে নতুন রাজ্য কমিটি তৈরি করেন। তখন রাজ্য বিজেপিতে ‘বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী’ তৈরি হয়। জেলায় জেলায় দিলীপ ঘনিষ্ঠদের বাদ পড়া নিয়েও নানা অভিযোগ ওঠে। এমনই এক সময়ে গত এপ্রিল মাসে দিলীপ বলেছিলেন, ‘‘সুকান্তর অভিজ্ঞতা কম, সবে দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু ওঁর জানা উচিত যাঁরা এত দিন আন্দোলন করেছেন, তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।’’ শুধু তা-ই নয়, সুকান্তকে দিলীপ এ কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘‘দলের এই পুরনো নেতাদের উপর বিশ্বাস করেই মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। তাই তাঁদের ভুলে গেলে চলবে না।’’
প্রথমে চুপ করেই ছিলেন সুকান্ত। পরে জবাব দেন দিলীপের মেদিনীপুরে গিয়েই। দিলীপের সঙ্গেই দলের একটি কর্মসূচিতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘শুরুতেই কারও অভিজ্ঞতা থাকে না। আমি যখন রাজ্য সভাপতি হয়েছি তখন আড়াই বছর সাংসদ থাকার অভিজ্ঞতা ছিল। আর দিলীপ ঘোষ যখন সভাপতি হন তখন ছ’মাস, এক বছরের অভিজ্ঞতা ছিল।’’ সে দিন দিলীপকেও পুরনো মন্তব্য গিলতে হয়েছিল। দিলীপ বলেছিলেন, ‘আমরা একসঙ্গেই রয়েছি। পাশাপাশিই রয়েছি। আমরা মাত্র ৪২ বছর বয়সের একজনকে রাজ্য সভাপতি করেছি। যে দলের এত জন সাংসদ, বিধায়ক রয়েছেন সেই দলে এত কম বয়সের কাউকে সভাপতি করতে দেখা যায় না। অন্য দলে তো বুড়ো-হাবড়াদের সভাপতি করা হয়!’’
প্রকাশ্যে বিবাদ না দেখা গেলেও সুকান্ত জমানায় খুব সুখে শেষ এক বছর কাটাতে পারেননি দিলীপ। বিজেপিতে নামে বড় হলেও গুরুত্বে ‘রাজ্য সভাপতি’ পদের তুলনায় ‘সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি’ পদের জৌলুস অনেকটাই কম। কাছাকাছিও নয়। কিন্তু দিলীপ যেন পুরনো পদ পুরোপুরি ভুলতে পারেননি। একের পর এক মন্তব্যে রাজ্য নেতৃত্বের ত্রুটি ধরাতে থাকেন। তাঁর ঘনিষ্ঠরা অবশ্য বলেন, ‘‘দিলীপদা অভিজ্ঞতার নিরিখেই রাজ্য নেতৃত্বের ভুলত্রুটি দেখলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।’’
এই ‘চোখে আঙুল দাদা’-গিরি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভাল চোখে দেখেননি। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে রাজ্য নেতৃত্বকে দিলীপ ‘বিব্রত’ করছেন বলে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছিল। আর তার প্রেক্ষিতেই ৩১ জুন দিলীপকে ‘সেন্সর’ করেন বিজেপি নেতৃত্ব। নড্ডার হয়ে চিঠি পাঠান দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সদর দফতরের ভারপ্রাপ্ত নেতা অরুণ সিংহ। লেখা হয়, ‘আপনার এমন আচরণে দলীয় নেতৃত্ব গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন এবং মর্মাহত। দলীয় নেতৃত্ব আশা করে এ বার বিষয়টিতে আপনি গুরুত্ব দেবেন, নিজের পদমর্যাদার প্রতি সুবিচার করে আপনি দলকে উদ্বুদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন।’
এর পরে অনেকটাই চুপ হয়ে যান দিলীপ। তবে সবটা বদল আসেনি। রাজ্য সভাপতি থাকার সময়ে তিনি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এতটাই ঘুরতেন যে, দলে তাঁকে ‘গেছোদাদা’ বলা হত। সেই ধারা বজায় রেখে এখনও অনেক সময়েই তিনি রাজ্য নেতৃত্বকে না জানিয়েই বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে প্রকাশ্যে তিনি সে সব কিছু বলেন না। বরং, অনুজ সুকান্ত সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি ছিলাম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে আগে ব্যাট করতে নামা দলের ক্যাপ্টেন। রানের টার্গেট ছিল না। যেমন খুশি চালিয়ে খেলেছি। সাংসদ সংখ্যা দুই থেকে ১৮ হয়েছে। বিধায়ক তিন থেকে বেড়ে ৭৭ হয়েছে। কিন্তু সুকান্তের লড়াই তুলনায় কঠিন। রান তাড়া করতে হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আগামী লোকসভা নির্বাচনে উনি লক্ষ্য ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবেন। নতুন রেকর্ড তৈরি করবেন।’’
সুকান্তও দিলীপের বিরোধিতায় কোনও সরাসরি আক্রমণ করেননি। দিলীপের সঙ্গে তাঁর দল পরিচালনার ফারাক সম্পর্কে নিজের ভাবনার কথাটা কিছু দিন আগেই আনন্দবাজার অনলাইনে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, ‘‘দিলীপ’দা আমাদের সম্মাননীয় নেতা। অস্বীকার করতে পারি না যে, দিলীপ ঘোষ রাজ্য বিজেপিকে অনেকটা দূর এগিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। কর্মী-সমর্থকদের লড়াই করার মানসিকতা তৈরি করেছেন।’’ পাশাপাশিই বলেছিলেন, ‘‘তাঁর অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব আমার কাছে এসে পড়েছে। তবে ওঁর জুতোয় পা গলানো নয়। নিজের জুতো পরে দৌড় দেওয়াই ভাল। না হলে রাস্তা একই হয়ে যাবে।’’