Personal Attack

বাংলার রাজনীতিতে ব্যক্তি আক্রমণ থাকলেও ‘যৌনগন্ধী’ খোঁচা ছিল না, নয়া ‘সংস্কৃতি’তে চিন্তিত বিশিষ্টেরা

এক জন আর এক জনের যৌন পছন্দ নিয়ে আক্রমণ করলেন। পাল্টা আক্রমণ এল পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে। দুই রাজনীতিকের একে অপরের লড়াইয়ে আসলে আক্রান্ত বাংলার সংস্কৃতি, রুচি। এমনই মনে করছেন রাজ্যের বিশিষ্টদের একাংশ।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:১১
বাংলার রাজনীতিতে ব্যাক্তি আক্রমণের সঙ্গে এখন ‘যৌনতা’-র মিশেল ঘটছে বলে উদ্বিগ্ন বাংলার বিশিষ্ট সমাজের একাংশ।

বাংলার রাজনীতিতে ব্যাক্তি আক্রমণের সঙ্গে এখন ‘যৌনতা’-র মিশেল ঘটছে বলে উদ্বিগ্ন বাংলার বিশিষ্ট সমাজের একাংশ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

যুক্তি যখন হারিয়ে যায়, নীতি যখন লড়াই করতে পারে না, তখনই আসে ব্যক্তি আক্রমণ। বলেন মনোবিদ থেকে সমাজতাত্বিকরা। তবে কি সেই যুক্তি ও নীতিহীনতাই বাংলার রাজনীতিকে গ্রাস করছে? এমন প্রশ্ন উঠছে সাম্প্রতিক ‘রাজনৈতিক’ চাপানউতরে। যে চাপানউতরকে আদৌ রাজনীতি বলেই মানতে চান না অনেকে। ব্যক্তিগত আক্রমণ অবশ্য রাজনৈতিক লড়াইয়ে নতুন নয়। কিন্তু সেই ব্যাক্তি আক্রমণের সঙ্গে এখন ‘যৌনতা’-র মিশেল ঘটছে বলে উদ্বিগ্ন বাংলার বিশিষ্ট সমাজের একাংশ।

দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা থাকা কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষকে ‘কানা অতুল্য’ বলা থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে দিলীপ ঘোষকে ‘ফিটার মিস্ত্রি’ বলে আক্রমণ করার নজির এই বাংলাই রেখেছে। তবে সে আক্রমণকে আরও নিন্দনীয় করে কিছু দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (তিনি আবার মহিলাও) জন্ম-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলেছিলেন দিলীপ। তাঁর যুক্তি ছিল ‘ইটের বদলে পাটকেল’। কিন্তু রাজ্যের বিশিষ্টদের একাংশ গোটা বিষয়টাকেই ‘নিকৃষ্ট রাজনীতি’ হিসাবে দেখছে।

Advertisement

অনেক মনে করেন ব্যক্তি আক্রমণ বৃদ্ধির পিছনে এটাও একটা বড় কারণ যে, ভারতীয় রাজনীতি এখন মূলত ব্যক্তিনির্ভর। বিজেপি সংগঠনভিত্তিক দল হলেও এটা ঠিক যে, এখন তারা মোদী-নির্ভর দল। তাই প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করতে বিরোধীরা তাঁর বিবাহিত জীবনের কথা টেনে আনেন। তাঁর ‘নিকন’ কোম্পানির ক্যামেরায় ‘ক্যানন’-এর লেন্স ক্যাপ পরিয়ে বিরুদ্ধ প্রচারের চেষ্টা করে। তবে বিরোধীদেরই বা একা দোষ দেওয়া কেন! বিজেপি-ও দীর্ঘদিন কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গাঁধীকে ‘বিদেশিনী’ বলে আক্রমণ করেছে। বিবাহপূর্ব জীবনের অসমর্থিত কাহিনি প্রচার করেও কুৎসা করা হয়েছে।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে এই ব্যক্তি রাজনীতির আক্রমণ আরও বেড়েছে তৃণমূল বনাম বিজেপি লড়াইয়ে। আরও স্পষ্ট করে বললে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম শুভেন্দু অধিকারীর বাগ্‌যুদ্ধে। শুভেন্দু ‘পুরুষ পছন্দ করা নেতা’ বলে অভিষেকের মন্তব্যের পরে তৃণমূলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ বিরোধী দলনেতার ‘যৌন পছন্দ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সরাসরি ‘যৌনবিকৃতি’ বলে আক্রমণ করেছেন। বিরোধী দলনেতাও সরব। তিনি অস্ত্র করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দীপক ঘোষের একটি বইয়ের দাবিকে। শাসক শিবিরের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রকাশ্যে কটূক্তি করেছেন।

এর প্রেক্ষিতেই নোংরা রাজনীতির ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছেন বিশিষ্টেরা। পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির কথায়, ‘‘মহাভারতে কর্ণকে সূতপুত্র বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা তো মহাভারতের যুগ! আর এটা তো পরিশীলিত একবিংশ শতাব্দী। আসলে যুক্তিহীনতাই রাজনীতিকে কলুষিত করছে।’’ নৃসিংপ্রসাদ মনে করেন, যে পক্ষ এটা শুরু করে, তাদেরই নিন্দা করে উচিত। কারণ, এক বার শুরু হলে তা থামানো কঠিন। এই ধরনের শব্দ ও বিষয় নির্বাচন আগামী দিনে রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমিয়ে দেবে বলেও মনে করেন তিনি।

একই মত শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহারের। তাঁর কথায়, ‘‘রাজনীতিক শব্দটা এখন নিন্দাসূচক শব্দ। আমি রাজনীতি করি না বলার মানে আমি নিন্দনীয় কাজ করি না।’’ মীরাতুনের মতে ‘‘এখন রাজনীতি মানে বিবাদ। আর বিবাদে যা হয়— কলহ, মারামারি, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার। মানুষের মনে যখন প্রচণ্ড রাগ তৈরি হয়, তখন মুখে গালাগাল আসে। সেটাই বাড়তে বাড়তে পর্যায়ক্রমে নিম্নপ্রবৃত্তি বাড়ছে। উচ্চপ্রবৃত্তি হেরে যাচ্ছে। যে ‘যৌনতা’ সৃষ্টির মূল কথা, সেই শব্দটিকেও নিম্নপ্রবৃত্তি প্রকাশের মাধ্যম করা হচ্ছে। যৌনগন্ধী শব্দ ব্যবহার করে দুর্গন্ধ ছড়ানো হচ্ছে। মানুষের গায়ে তা লেপ্টে যাচ্ছে।’’

রাজনীতিতে ‘যৌনগন্ধী’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে চিন্তিত শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারও। তিনি বলেন, ‘‘যৌনতার অনুষঙ্গ এনে আক্রমণ করা হচ্ছে। যে সব শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন প্রসঙ্গ টেনে আনা হচ্ছে, তা বাঙালির রুচির পক্ষে, সংস্কৃতির পক্ষে খুবই লজ্জাজনক। এমন রুচি বাঙালির আগে ছিল না। এখন ছাত্রছাত্রীরাও শুনছে। তারাও আর কাউকে শ্রদ্ধা করবে না। এটা অত্যন্ত লজ্জার।’’ সরাসরি বর্তমান প্রসঙ্গ টেনে পবিত্র বলেন, ‘‘আমি শুভেন্দুর রাজনীতির বিপক্ষে। কিন্তু উনি এমন কিছু করেননি, যে তাঁকে যৌনগন্ধী শব্দ ব্যবহার করে আক্রমণ করা যায়। আবার উনিও পাল্টা যেটা বলছেন, সেটা ঠিক নয়। আসলে যুক্তি হারিয়ে গেলেই মানুষ এগুলো করতে শুরু করে।’’

যুক্তি হারানোটাই যে মূল কারণ, তা বলছেন সমাজতত্ত্বের প্রবীণ শিক্ষক প্রশান্ত রায়। তাঁর কথায়, ‘‘যখন কাজের কথা বলার থাকে না, তখন লোকে এমন অকাজের কথা বলে। ব্যক্তিগত আক্রমণ করার চল শুধু রাজনীতি নয়, সব ক্ষেত্রেই আছে। কিন্তু এ খুবই দুঃখের যে, এখনও এ সব নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। কারও পিতৃপরিচয় কখনও রাজনীতির অঙ্গ নয়। যদি তৃণমূলের সব কাজ খারাপ লাগে, তা হলে তা নিয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু ব্যক্তিগত নিন্দা হল যে কোনও মানুষকে অসম্মান করার সবচেয়ে সহজ পথ। আর রাজনীতিতে তা ব্যবহার করা হয় কারণ, জনগণ অনেক ক্ষেত্রেই তা লুফে নেবে। মুখে মুখে ছড়াবে সে নিন্দা। মোদীর বয়স নিয়েও তো চর্চা শুরু হয়েছিল। তাঁর কাজ নিয়ে নিন্দা করা এক। আর ব্যক্তিগত জীবন আর এক। কিন্তু সাধারণত সহজ পথই বেছে নেন অধিকাংশ। তাই রাজনীতিতে ব্যক্তিগত আক্রমণ হতেই থাকে।’’

আরও পড়ুন
Advertisement