Buddhadeb Bhattacharjee Death

রাজনীতিক না হলে শিক্ষক, লেখক বা চিত্রপরিচালক হতেন

নন্দীগ্রামের ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যা বলেছিলাম, তাতে উনি আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। নিজের প্রতিও বিরক্ত হয়েছিলেন। কারণ, তাঁর দলের নামে, সরকারের নামে কী হচ্ছিল, তা তিনি টের পাননি।

Advertisement
গোপালকৃষ্ণ গান্ধী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৪ ০৮:০৭
স্মৃতি: বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও গোপালকৃষ্ণ গান্ধী।

স্মৃতি: বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। —ফাইল ছবি।

যদি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মার্ক্সের দ্বারা অনুপ্রাণিত না হতেন? যদি রাজনীতিতে যোগ না দিতেন? সরকারের মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী না হতেন? তা হলে তিনি কী হতেন?

Advertisement

তিনি অবশ্যই বরাবরের মতো সুদর্শন হতেন। চোখে পড়ার মতো সুদর্শন। সে তিনি যে কোনও ভূমিকায়, যে কোনও পেশাতেই থাকতেন না কেন! এমনকি কোনও পেশায় বা বিশেষ ভূমিকায় না থাকলেও! সে ক্ষেত্রেও তিনি অল্প কথা বলতেন। হাতটাত বিশেষ ছুড়তেন না। মাঝেসাঝে ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যেত। মুখ খুলে হাসলে সেটা বিরল ঘটনাই হত। আর জোরে জোরে কখনও হাসতেন না। তাঁর বন্ধুর সংখ্যা কমই থাকত। বন্ধু বলতে আমি বোঝাচ্ছি, যাঁদের সঙ্গে উনি মন খুলে, প্রাণ খুলে কথা বলতেন। তাঁর সহকর্মী, সঙ্গীরা ওঁর প্রত্যেকটি শব্দ গোগ্রাসে গিলতেন। ওঁর পরিচিতের সংখ্যা অনেক হত, ওহ, বেশ অনেক জন! অগণিত ভক্ত, অনুরাগী থাকত।

আর তাঁর প্রথমে কালো, তার পরে সাদা-কালো, শেষে ধপধপে সাদা চুলের মাথা সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘেরা থাকত। তিনি সব ক্ষেত্রেই পরিষ্কার, অল্প মাড় দেওয়া, সাধারণত পাড় ছাড়া ধুতি পরতেন। আর তাঁর পরনের পাঞ্জাবিও ঠিকঠাক মাপের সেলাই করা, পরিষ্কার করে কাচা, ভাল করে ইস্ত্রি করা থাকত। তাঁর সাজসজ্জা বা আচরণে কোনও বেখাপ্পা বা অসতর্ক কিছু দেখা যেত না। ও সব করে তিনি নিজেকে সহজ-সরল বা বিনয়ী প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন না। যে কোনও ক্ষেত্রেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিরহঙ্কার হতেন। তাঁর কোনও ‘ইগো’ থাকত না। কখনও বিনয়ী সাজার চেষ্টাও করতেন না। বস্তুত, উনি যা-ই করতেন, সকলের থেকে অনেকখানি আলাদা হতেন।

কিন্তু রাজনৈতিক নেতা না হলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কী হতে পারতেন? আমার মনে হয়, এই তিনটির মধ্যে যে কোনও একটি। চলচ্চিত্র পরিচালক। লেখক। শিক্ষক। আর এর মধ্যে যে কোনও পেশায় উনি সবচেয়ে সেরা হতেন।

এই তিনটি কাল্পনিক ভূমিকার মধ্যে যদি উনি সিনেমার পরিচালক হতেন? এক দিকে সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন এবং অন্য দিকে ঋত্বিক ঘটক, ঋতুপর্ণ ঘোষ, দুই প্রজন্মের মধ্যে উনি সেতুবন্ধন করতেন। এই কাজে শিখর ছুঁতে পারতেন। তাঁর সিনেমার নিজস্ব চরিত্র, মনস্তত্ত্ব, শিল্পকলা থাকত। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর সিনেমায় সংলাপ হত মুচমুচে। অবশ্যই সাদা-কালোয় সিনেমা বানাতেন। হয়তো বলতেন, রং মিথ্যে বলে। লিপস্টিক, নেলপালিশ, চুলের রং হয়। জীবনের নয়।

লেখক হলে উনি উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখতেন। কবিতা নয়। উনি আর এক বিভূতিভূষণ হতেন। এক শহুরে বিভূতিভূষণ। আর তৃতীয় ক্ষেত্রে শিক্ষক হলে উনি ক্লাসরুমে তারকা হতেন। আলোচনাসভায় চাঁদের মতো আলো ছড়াতেন। সূর্যের মতো বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঝলসে দিতেন। কিন্তু উনি রাজনীতি বেছে নিয়েছিলেন। রাজনীতির জন্য ভাল হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের জন্য ভাল হয়েছিল। তবে সেখানেও তিনি ছিলেন এক জন শিল্পী। এক জন আচার্য। মার্ক্সবাদের প্রতি দায়বদ্ধ, সিপিএমের প্রতি অনুগত, বামপন্থার প্রতি অটল বুদ্ধবাবু সুন্দরের পূজারী ছিলেন। ভদ্রতা, সভ্যতার অবস্থান থেকে তিনি মানুষ, ঘটনাবলির বিচার করতেন। তাঁর মধ্যে কিছু একটা সব সময় অসুন্দর, অভদ্রতার প্রতি বিদ্রোহ করত।

রাজভবনে প্রায়ই আমাদের নিভৃতে কথা হত। এক বার ওঁর দলের এক সহকর্মী সম্পর্কে আমার কী ধারণা, তা বলেছিলাম। সেই লোকটি যা করেছিল, তাতে রাজ্যের, সরকার এবং ওঁর দলেরও ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছিলাম। উনি আমার কথা শোনার সময় প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তার পরে শুধু বলেছিলেন: ‘ওই লোকটা একটা চোর।’ তাতেই সব বলা হয়ে গিয়েছিল। ভবিষ্যতের ঘটনাবলি ওঁর এবং আমার ধারণা ঠিক প্রমাণ করেছিল। সবজান্তার মতো কথা বলা লোকেদের সম্পর্কে একটা শব্দ ব্যবহার করতে উনি খুব ভালবাসতেন: ‘বোগাস’। ওই কথাটা বললেই বুঝে যেতাম, উনি কী বলতে চাইছেন। রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমাদের মধ্যে চিঠির আদানপ্রদান চলত। আমার চিঠিগুলো লম্বা হত। উনি কখনও তিন-চার লাইন পেরোতেন না।

নন্দীগ্রামের ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যা বলেছিলাম, তাতে উনি আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। নিজের প্রতিও বিরক্ত হয়েছিলেন। কারণ, তাঁর দলের নামে, সরকারের নামে কী হচ্ছিল, তা তিনি টের পাননি।

সিঙ্গুর নিয়ে রাজভবনের দোতলায় আমার অফিসে রাজ্য সরকার ও তৃণমূলের মধ্যে বোঝাপড়া হল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে নিচের হলঘরে চলে গেলেন। সেখানে সাংবাদিকেরা অপেক্ষা করছেন। বুদ্ধবাবু আর আমি লিফটে এক তলায় নামছিলাম। সে দিন লিফটে উনি একটাই কথা বলেছিলেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’।

কলকাতা ছাড়ার আগের দিন ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। বুদ্ধবাবু বিমানবাবুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। মন ছুঁয়ে যাওয়া উপহার দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’। এর থেকে আর কিছু যথাযথ হত না। ফুল আনলে কিছু দিন পরে শুকিয়ে যেত। শাল আনলে কিছু দিন পরে রোঁয়া উঠে যেত। কিন্তু একটা বই, যে বইয়ের প্রতিটি শব্দ উনি উপলব্ধি করেছিলেন। যদি ভারতীয় রাজনীতিতে এমন কেউ থাকেন, যিনি আমার কাছে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’-এর প্রতীক, তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যিনি প্রথম ২০০৪ সালে রাজভবনে আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিলেন। মন দিয়ে ওঁর কথাগুলো শুনেছিলাম। উনি নিজের পক্ষ সমর্থনে কিছু বলেননি। তার পরে উনি কিছু জানতে চাইলেন। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করলাম। অল্প কথায় উত্তর দিলেন। আমি বললাম, ‘বুদ্ধবাবু, আমি অমুক সিনেমাটা দেখব বলে ভাবছি।’ একটা বাংলা সিনেমা। উনি বললেন, ‘দেখবেন না। সময়ের অপচয় হবে। কোন বাংলা সিনেমা দেখবেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করুন। বেশির ভাগই ছাইপাঁশ।’

শেষে বুদ্ধবাবু জানতে চেয়েছিলেন, আমার কত সালে জন্ম। যখন বললাম ১৯৪৫-এ, উনি বললেন, ‘আমার ১৯৪৪-এ জন্ম।’ আর কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না। মীরাদেবী, ওঁদের সন্তান সুচেতনের কাছে ওঁর স্মৃতি থেকে যাবে। ওঁর অনুরাগীরা স্মৃতিচারণ করবেন। ধন্যবাদ জানাবেন এমন এক জনের সমসাময়িক হওয়ার জন্য, যিনি কোনও নির্জন সুন্দর দ্বীপে ঝিনুকের খোলসের আবরণে থাকা মুক্তোর মতোই দুর্লভ।

(পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল)

আরও পড়ুন
Advertisement