মাদ্রিদে বাণিজ্য সম্মেলনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে হয়তো লিখতেন, ‘মহারাজের রাজদণ্ড দেখা দিল বণিকের মানদণ্ড রূপে’।
জন্ম থেকে তিনি নামগত ভাবে ‘মহারাজ’। পেশাগত ভাবে প্রথমে ক্রিকেটার। তার পরে জনপ্রিয় অ্যাঙ্কর, ধারাভাষ্যকার, ক্রিকেট দলের মেন্টর ইত্যাদি। মাদ্রিদের মঞ্চে তিনি আবির্ভূত হলেন তৃতীয় অবতারে— বণিক। ব্যবসায়ী। যিনি ইতিমধ্যেই দু’টি ইস্পাত কারখানা খুলে ফেলেছেন। একটি পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে। দ্বিতীয়টি পটনায়। তৃতীয়টি খুলতে চলেছেন পশ্চিম মেদিনীপুরে। যে কারখানা সম্পর্কে তিনি জানালেন, প্রাথমিক ভাবে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। অনেক দিন ধরেই ভাবনাচিন্তা চলছিল। তার পরে ছাড়পত্র পাওয়া গিয়েছে। নির্মাণের কাজও শুরু হয়ে যাবে।
বস্তুত, শুক্রবার মাদ্রিদে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত শিল্প সম্মেলনে যে ‘মহারাজ’কে দেখা গেল, তাঁর হাতে আর রাজদণ্ড নেই। বদলে আছে বণিকের মানদণ্ড। যিনি সমবেত জনতাকে খানিক বিস্মিত করেই নিজের ইস্পাত কারখানার কথা জানিয়ে বললেন, ‘‘লোকে যদিও ভাবে, আমি শুধু ক্রিকেটটাই খেলেছি!’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্পেনের বিখ্যাত লিগ লা লিগার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় উপস্থিত থাকবেন, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এতেও আশ্চর্যের কিছু নেই যে, শনিবার রিয়েল মাদ্রিদের স্টেডিয়াম সান্তিয়াগো বের্নাব্যু সফরে মমতার সঙ্গী হবেন সৌরভ (তার পরেই তাঁর স্ত্রী ডোনা এবং কন্যা সানাকে নিয়ে লন্ডন ফেরার কথা)। কারণ, সৌরভ প্রাথমিক ভাবে খেলাধুলোর বিগ্রহ হিসেবেই এখনও সমধিক পূজিত হন। মাদ্রিদের শিল্প সম্মেলনের বক্তা তালিকাতেও তাঁর লিখিত পরিচয় ছিল ‘প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক এবং বিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি’। কিন্তু তিনি কেন শিল্প সম্মেলনে বক্তা হবেন?
কেন হবেন, বোঝা গেল, যখন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তথা মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় সৌরভের লিখিত পরিচয়ের সঙ্গে আরও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ কিছু জুড়ে দিলেন, ‘‘সৌরভ এখন খেলার আঙিনা ছাড়িয়ে বিনোদন, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নিজেকে প্রসারিত করেছেন। তিনি বাণিজ্য নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা বলবেন।’’
সৌরভ বললেনও বটে তা-ই। প্রথমেই বললেন, তাঁদের পরিবার ৫০-৫৫ বছর আগে কলকাতায় একটি ছোট ব্যবসা (মুদ্রণের) শুরু করেছিল। তার পরে যে ক্রমশ তার প্রসার বেড়েছে এবং তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা এই কলেবরে পৌঁছেছে, তা পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির জন্যই। সৌরভের কথায়, ‘‘বাংলা স্পোর্টস, কালচার এবং এনটারটেনমেন্ট অর্থাৎ, ক্রীড়া, সংস্কৃতি এবং বিনোদনের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে। আমি এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছি। ইটস অ্যাবাউট দ্য বিজনেস অফ স্পোর্টস। স্পোর্টস ইজ অ্যান অ্যামেজিং ইন্ডাস্ট্রি।’’ অর্থাৎ, ক্রীড়াবিদ সৌরভ এখন ক্রীড়াবণিকও বটে।
যেমন তিনি শিল্প সম্মেলনের পরে ‘টেকনো ইন্ডিয়া’র চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর সত্যম রায়চৌধুরীর সঙ্গে একটি স্পেনীয় সংস্থার ‘মউ’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে থাকতে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। যেমন তিনি বললেন, ‘‘লা লিগা কলকাতায় অ্যাকাডেমি গড়ার জন্য স্টেডিয়াম চেয়েছে শুনলাম। কিন্তু আমি বলব, শুধু অ্যাকাডেমি গড়লে হবে না। ফুটবলটাকেও গড়তে হবে।’’ পাশাপাশিই, উপস্থিত স্পেনীয় শিল্পমহলের প্রতিনিধিদের বললেন, ‘‘যখন আপনারা বাংলায় বিনিয়োগ করবেন, তখন আপনারা আমাদের রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের জন্য সম্ভাবনাও নিয়ে আসবেন বলে আমার বিশ্বাস।’’
তার পরেই বাংলার ‘শিল্পবান্ধব’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে গিয়ে বললেন, ‘‘আমরা ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে একটা ছোট ইস্পাত কারখানা শুরু করেছিলাম। সেটা চার-পাঁচ মাসে শুরু করা গিয়েছিল। তার বেশি সময় লাগেনি। এখন বাংলার পরিস্থিতি তার চেয়েও ভাল হয়েছে। আমরা আরও একটা ইস্পাত কারখানা তৈরি করতে চলেছি।’’
সৌরভ যখন ওই কথা বলছেন, তখন উপস্থিত সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। কারণ দু’টি। এক, সৌরভ যে একটি ইস্পাত কারখানার মালিক, তা কারও জানা ছিল না। দুই, সেই মুহূর্তে সৌরভের আবির্ভাব হল তাঁর বণিক অবতারে। মহারাজার রাজদণ্ড পরিণত হল বণিকের মানদণ্ডে।
তবে ইতিহাস বলছে, ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য সৌরভের বরাবরই বাণিজ্যে মনোযোগ ছিল। তাঁর খেলার কেরিয়ার মধ্যগগনে থাকতে থাকতেই সৌরভ তাঁর নামের রেস্তরাঁ খুলেছিলেন পার্ক স্ট্রিটের অদূরে। পাকেচক্রে তা এখন আর নেই। কিন্তু সৌরভের ব্যবসাবুদ্ধি নিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠেরা বরাবর ওয়াকিবহাল। কারণ, সৌরভের মতো তাঁরাও জানেন, বিনোদন জগতের মতোই ক্রীড়াবিদের পেশাগত জীবনের আয়ুও স্বল্প। যে কারণে সচিন তেন্ডুলকরও রেস্তরাঁ খুলেছিলেন। যে কারণে রেস্তরাঁ-সহ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন বিরাট কোহলিও। অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি সৌরভের বহু দিন ধরেই কলকাতার উপকণ্ঠে একটি স্কুল খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। সে বাবদে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে জমিও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সে কাজ এখনও খুব একটা এগোয়নি। তবে সৌরভ সেই পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়েছেন বলে এখনও পর্যন্ত খবর নেই।
তার মধ্যেই আচমকা মাদ্রিদের মঞ্চে বণিকের মানদণ্ড হাতে তাঁর আবির্ভাব। যে মানদণ্ড হাতে শিল্পোদ্যোগী সৌরভ জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা, মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী এবং শিল্প ও বাণিজ্যসচিব বন্দনা যাদব তাঁকে প্রভূত সাহায্য করেছেন এই ইস্পাত কারখানা গড়তে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি চিন্তিত তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে। তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।’’ যে কথা তিনি মঞ্চ থেকে তাঁর ভাষণেও বলেছেন। সম্মেলনের শেষে তিনি যে ভাবে শিল্পপতিদের সঙ্গে মিশে গেলেন, সেটাও তাঁর অফ ড্রাইভের মতোই মসৃণ।
শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে...।