মাদ্রিদে বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
শিল্পের জন্য বাংলার মাটি কতটা উর্বর, মাদ্রিদে স্পেনের বণিকমহলের সামনে তা তুলে ধরলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন— বাংলা এমন এক রাজ্য যেখানে পাহাড়, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র সব রয়েছে। রয়েছে দক্ষ কর্মীবাহিনী। রয়েছে সম্প্রীতির পরিবেশ। স্পেনীয় শিল্পপতিদের মুখ্যমন্ত্রী আমন্ত্রণ করলেন বাংলায় আসতে, দেখতে এবং বিনিয়োগ করতে। মমতার আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে স্পেনের শিল্পমহল থেকে। শুক্রবারের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্পেনের শিল্প মন্ত্রকের প্রতিনিধি আলিসিয়া ভারেলা দোনোসো। আলিসিয়া তাঁর বক্তৃতায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করেন। বাংলা তথা ভারতের সঙ্গে এই ধরনের যৌথ শিল্প সম্মেলন আরও বেশি করে করার উপরেও জোর দেন তিনি।
শুক্রবার মাদ্রিদে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে উপস্থিত স্পেনের শিল্পপতিদের উদ্দেশে মমতার বার্তা, পর্যটন থেকে ক্রীড়া নানান ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য বাংলার দরজা খোলা। শিল্পের জন্য যা যা প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম যোগাযোগ ও দক্ষ শ্রমিক। স্পেনের বণিকমহলের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমাদের বাংলায় সমস্ত ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষিত শ্রমিকও রয়েছেন। আপনারা আসুন।’’
স্পেনের বণিকমহলের তরফে মাদ্রিদের বাণিজ্য সম্মেলনে ছিলেন এ হেইমে মন্তালভো, হুয়ান ইগনাসিও এন্ত্রেক্যানালেস। দু’জনেই বলেন, বাংলায় বিনিয়োগের বিষয়ে তাঁরা উৎসাহী। মন্তালভো স্পেনের চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট। তাঁর কথায়, ‘‘ভারত ক্রমশ অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ হচ্ছে। রাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গেরও আর্থিক রেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী। আমরা আশাবাদী, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিনিয়োগ ও শিল্পস্থাপনের বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’’
হুয়ান ইগনাসিও ‘স্পেন ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফাউন্ডেশন’-এর প্রেসিডেন্ট। হুয়ান বলেন, ‘‘বাংলা ভারতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে উঠে এসেছে। বাংলা অবশ্যই স্পেনীয় শিল্পপতিদের গন্তব্য হতে পারে। আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টা খতিয়ে দেখব।’’ বিশেষ করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি এবং পর্যটনের ক্ষেত্রে বাংলার সম্ভাবনা খুবই ভাল বলে তিনি মনে করেন।
স্পেনের শিল্প মন্ত্রকের প্রতিনিধি আলিসিয়া ভারত এবং স্পেনের মধ্যেকার বাণিজ্যিক সম্পর্কের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জানান, স্পেনে বিনিয়োগকারী ভারতীয় সংস্থার সংখ্যা এই মুহূর্তে ৮২। আর ভারতে বিনিয়োগ করা স্পেনীয় সংস্থা ২০০টির মতো। বাংলার প্রসঙ্গ টেনে আলিসিয়া বলেন, ‘‘এই ২০০টির মধ্যে মাত্র তিনটির বিনিয়োগ রয়েছে বাংলায়। এটা আমরা বাড়ানোর চেষ্টা করব। বাংলায় শিল্প-সম্ভাবনা প্রচুর।’’ এই ধরনের বৈঠক আরও হওয়া দরকার বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘‘এটা একটা ঐতিহাসিক সফর। এতে ভারত-স্পেন এবং পশ্চিমবঙ্গ-স্পেন সম্পর্ক দৃঢ় হবে। আমাদের দুই দেশের সামনেই যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, তা যৌথ ভাবে মোকাবিলা করা দরকার। এমন বৈঠক আরও হওয়া উচিত।’’
লগ্নির সন্ধানে কেন তিনি স্পেনে গেলেন, মমতা তাঁর শুক্রবারের বক্তৃতায় তা-ও তুলে ধরেন। মমতা বলেন, ‘‘আজ থেকে কয়েক মাস আগে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় স্পেন ছিল থিম। তখন তাঁরা আমায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি পাঁচ বছর কোথাও যাইনি। ঠিক করেছিলাম, এর পর কোথাও গেলে স্পেনেই যাব।’’ প্রসঙ্গত কলকাতা বইমেলার আয়োজক পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের দুই কর্তা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় ও সুধাংশুশেখর দে মমতার সফর-দলে রয়েছেন। স্পেনের প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে বৃহস্পতিবার একটি ‘মউ’ও স্বাক্ষরিত হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বাংলার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে গিয়ে সামাজিক প্রকল্পগুলির কথা তুলে ধরেন। কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের কথা উল্লেখ করেন তিনি। চলতি বছরের ২১ থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে স্পেনের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘আপনারা আসুন। বিনিয়োগ করুন। যদি বিনিয়োগ না-ও করেন, দেখে যান কত মউ স্বাক্ষরিত হচ্ছে।’’
শুক্রবারের অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের তরফে মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী বাংলার অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যাওয়া শিল্পপতিদের মধ্যে তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা, উমেশ চৌধুরী, আদিত্য আগরওয়াল, প্রশান্ত মোদী, শাশ্বত গোয়েঙ্কা বাংলার শিল্প পরিবেশের কথা তুলে ধরেন। শাশ্বত বলেন, ‘‘বাংলায় বিনিয়োগের যথার্থ পরিবেশ রয়েছে। রাজ্য সরকারও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করছে।’’ ইমামি গ্রুপের তরফে আদিত্য বলেন, ‘‘বাংলা থেকে শুরু করেই আমাদের ব্যবসা এখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যপ্ত হয়েছে।’’ ইমামি এখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে বিনিয়োগ করেছে। স্পেনের বণিকমহলের সামনে ক্রীাড়াক্ষেত্রে বিনিয়োগের আহ্বানও জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার লা লিগার সঙ্গে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল রাজ্য সরকারের। সেই অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কার্যত ফুটবলের ব্র্যান্ড-দূত হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শুক্রবার সেই সৌরভকে দেখা গেল শিল্পের ব্র্যান্ড-দূতের ভূমিকায়।
বাংলায় বিনিয়োগ টানা লক্ষ্য হলেও, মাদ্রিদের বাণিজ্য মঞ্চে ভারতের ধারণাও তুলে ধরেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘গণতন্ত্রই ভারতের মূল শক্তি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন রাজ্যে সরকার পরিচালনা করে। এবং বৈচিত্রের মধ্যেও ঐক্য রয়েছে।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘অন্য কোথায় কী হচ্ছে আমি বলব না। তবে বাংলায় আমরা সমস্ত জাতি, ধর্মকে সমান ভাবে শ্রদ্ধা করি।’’