শতবর্ষেও ঘুচল না দুর্দশা।
১৯২২ থেকে ২০২১— গত ১০০ বছরে বাংলা অনেক রকম ভাবে পাল্টে গিয়েছে। দেশে স্বাধীনতা এসেছে। জাতীয় রাজনীতিতেও হাজারও বদলের পাশাপাশি বাংলার রাজনৈতিক রং এক সবুজ থেকে লাল হয়ে ফের এখন অন্য সবুজে। কিন্তু ঘাটাল রয়েছে ঘাটালেই। তার প্লাবন-ভাগ্যে কোনও বদল আসেনি। শতবর্ষ আগে যেমন ছিল, আজও তেমনই রয়ে গিয়েছে। ১০০ বছর আগে এবং পরে— আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবরই তার ‘জল’জ্যান্ত প্রমাণ।
ভোটের আগে গাড়ির চাকায় ধুলো উড়িয়ে আসেন নেতারা। মেঘভাঙা বৃষ্টির মতো মুষলধারায় প্রতিশ্রুতি ঝরে পড়ে তাঁদের ভাষণে। কিন্তু ফি বছর প্রবল জলের তোড় যখন গ্রামের পর গ্রাম গিলে নেয়, সেই জলে ছায়া পড়ে না প্রায় কোনও নেতারই। লাইফ জ্যাকেটে সুসজ্জিত হয়ে যা-ও বা দু’এক জনের দেখা মেলে ঘাটালে, লোক জড়ো করে আইনি জটিলতার কথা শুনিয়ে তাঁরা চলে যান বলেই স্থানীয়দের দীর্ঘ দিনের অভিযোগ। স্থানীয়দের দাবি, যুক্তিতর্কের সুযোগ না দিয়ে প্রতিপক্ষ শিবিরের কুচক্রান্তের কথা শুনিয়ে যান তাঁরা।
তবে বছর বছর ঘাটাল প্লাবিত হওয়ার পিছনে রয়েছে ভৌগলিক কারণ। ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন শিলাবতী, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর-সহ একাধিক নদীর ভূমি ঢাল দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ঘাটালের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে জমে নদীগর্ভ ভরাট হয়ে জলধারণ ক্ষমতা কমে গিয়েছে সেগুলির। যে কারণে একটু বর্ষাতেই ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। তাতে একরের পর একর জমি, ফসল, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পশুপাখির সলিল সমাধি ঘটে। এ বছরও তার অন্যথা হয়নি। আর তাতেই নতুন করে উঠে এসেছে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ।
একটানা বৃষ্টি এবং ডিভিসি-র ছাড়া জলে গত কয়েক দিন ধরেই বানভাসি এ রাজ্যের একাধিক এলাকা। তবে বরাবরের মতো এ বারও ঘাটালের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর, যা ফের মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯২২ সালের অগস্ট মাস। কারণ সে বারের বানভাসি পরিস্থিতির সঙ্গে এ বার মিলে যাচ্ছে অনেকাংশেই। সে বার ঘাটাল মহকুমার ২৪৫ বর্গ মাইল এলাকা বন্যার জলে ডুবে গিয়েছিল। যত দূর চোখ যায়, শুধু জল আর জল, যাতে ‘জমিন-আসমান’-এর ফারাক বোঝাই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময়, ১৯২২-এর এমন এক বর্ষামুখর অগস্টে (১৭ তারিখ) আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে হাজার হাজার মানুষের ঘরছাড়া হওয়ার বিষয় প্রকাশ পেয়েছিল।
এত বছর পরেও, ঘাটালের পরিস্থিতি পাল্টায়নি এতটুকুও। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঘাটালের বিস্তীর্ণ এলাকায় ১২ থেকে ১৩ ফুট পর্যন্ত জল জমেছে। শুধুমাত্র ঘাটাল ব্লকেই ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ৫০টির বেশি গ্রাম জলের তলায় চলে গিয়েছে। ১০০টির বেশি গ্রামে জল কাঁধ ছুঁইছুঁই। প্রায় ২ লক্ষ মানুষ এ বারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে সামনে এসেছে। জায়গায় জায়গায় ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে পৌঁছতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এই ডিজিটাল যুগেও কলার ভেলায় চেপে পাড়ি দিতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। পানীয় জলের জন্য মানুষকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে সপ্তাহ ভর।
কিন্তু ঘাটালবাসীকে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পাঁচ দশক আগে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নামক বিশেষ পরিকল্পনা গৃহীত হলেও, আজও তার বাস্তবায়ন হয়নি। স্থায়ী ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ১৯৫৯ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে। কিন্তু তাতে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেতেই লেগে যায় দু’দশক। ১৯৯০ সালে অনুমোদন মিললে, ১৯৮২ সালে শিলাবতী নদীর ধারে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের সূচনা হয়। রুপোর কোদাল দিয়ে প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তৎকালীন বাম সরকারের সেচমন্ত্রী প্রভাস রায়। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ সালে ফের বিষয়টি নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলে, ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় প্রকল্পটির জন্য, ১৯৮২ সালে যা ৫০ কোটি বলে ঠিক হয়েছিল। কেন্দ্র এবং রাজ্য, দু’তরফে যথেষ্ট সক্রিয়তা না থাকায়, সে বারও প্রকল্পটি হিমঘরে চলে যায়।
২০০৯ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকারের আমলে কেন্দ্রের অধীনস্থ একটি সংস্থা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে নতুন করে রিপোর্ট তৈরির কাজে হাত দেয়। ২০১৫ সালে গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনের পূর্বাঞ্চল শাখা তাতে ছাড়পত্র দেয়। সেই মতো প্রকল্পটির খরচবাবদ ১ হাজার ২১৪ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। তবে এর আগে এই ধরনের প্রকল্পে কেন্দ্র এবং রাজ্য যেখানে যথাক্রমে ৭৫ ও ২৫ শতাংশ করে টাকা খরচ করত, নয়া নিয়মে দু’পক্ষকেই ৫০ শতাংশ করে টাকা খরচ করতে হবে বলে ঠিক হয়। নয়া প্রকল্পে ১৪৭ কিলোমিটার নদী ও নদীর বাঁধ সংস্কার, নারায়ণী ও কাঁকি খালে দু’টি স্লুইস গেট, পাম্প হাউস, ঘাটাল শহর সংলগ্ন শিলাবতী নদীর বাঁ দিকে দুই কিলোমিটার গার্ডওয়াল-সহ বিভিন্ন কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু সবটাই তো খাতায় কলমে। প্রথম ধাপের প্রকল্পটি সবুজ সঙ্কেত পেলেও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য এখনও কোনও টাকা বরাদ্দ হয়নি। এ দিকে যত দিন এগোচ্ছে তত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রকল্পের খরচ।
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হয়। তৎকালীন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া নিজে বার বার দিল্লিতে দরবার করেন। মানসের অভিযোগ ছিল, কেলেঘাই-কপালেশ্বরী প্রকল্পে রাজ্য নিজের কোষাগার থেকে ৭০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনও সাহায্য করেনি। মানসের পর সেচ দফতরের দায়িত্ব পান শুভেন্দু অধিকারী। তিনিও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ এনেছিলেন এক সময়। প্রয়োজনে ভিক্ষে করে হলেও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের রূপায়ণ করেই ছাড়বেন বলে এক সময় মন্তব্য করেন প্রাক্তন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কিন্তু সময়ের ফেরে এখন শুভেন্দু-রাজীব দু’জনেই বিজেপি শিবিরে। বিরোধী শিবিরে গিয়ে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়িত না হওয়ার জন্য মমতার সরকারকেই এখন দায়ী করছেন শুভেন্দু। আবার নতুন দলে গিয়ে আস্থা অর্জন করতে শুভেন্দু মিথ্যাচার করছেন বলে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন রাজ্যের বর্তমান সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র।
দু’দিন আগেই সেখানে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে যান তৃণমূল সাংসদ তথা অভিনেতা দেব। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়িত করতে বার বার কেন্দ্রকে চিঠি লিখেও লাভ হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী না হওয়া পর্যন্ত, এই দুর্দশা থেকে ঘাটালবাসী মুক্তি নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তাতে যদিও তৃণমূলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গত ১০ বছরে বারং বার সেচমন্ত্রী বদলালেও, ঘাটালে বন্যা প্রতিরোধের কাজ আজও বাস্তবায়িত করা যায়নি বলেই তাঁদের দাবি। রাজনৈতিক তরজা চরমে উঠলেও, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের নীল নকশা এখন কার্যত বিশ বাঁও জলেই।
শতবর্ষে বদলায়নি ঘাটালের ‘জল’ভাগ্য! বর্ষা মিটলেই ফের সব ভুলে যাওয়ার পালা। আসছে বর্ষায় আবার এ সব নিয়ে কথা হবে হয়তো।