Anubrata Mondal

কেষ্টর ১৯ ঘণ্টা: সকাল ৬.৪৫ থেকে রাত ১.৪৫, আসানসোল থেকে দিল্লির অশোকবিহার, কী কী হল

অনুব্রত মণ্ডলকে আসানসোলের জেল থেকে বার করা হয়েছিল সকাল পৌনে ৭টায়। দিল্লির অশোকবিহারে বিচারক রাকেশ কুমারের বাড়ি থেকে ইডি যখন তাঁকে বার করল, তখন রাত পৌনে ২টো।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩ ০৩:৫৮
Picture of Anubrata Mondal.

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

বাংলার জেল থেকে দিল্লির বিচারকের বাড়ি— প্রতি মুহূর্তই নাটকে ভরপুর। ১৯ ঘণ্টা ধরে চলা সেই সমস্ত মুহূর্তই শেষমেশ পৌঁছে গেল মধ্যরাতের মহানাটকে। বীরভূমের জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের দোল-দিবস শুরু হয়েছিল পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোলের জেল থেকে। মঙ্গলবার সারা দিন পেরিয়ে রাত যখন গভীর, মহানাটক শেষে দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতের বিচারক তখন নির্দেশ দিলেন, আগামী ১০ মার্চ পর্যন্ত এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর হেফাজতেই থাকবেন বীরভূমের কেষ্ট। ইডি আধিকারিক ও আইনজীবীদের সঙ্গে কেষ্ট তখন ওই বিচারকের দিল্লির অশোকবিহারের বাড়িতেই বসে।

মঙ্গলবার সকাল ৬টা ৪৫। দিল্লি নিয়ে যাওয়ার জন্য আসানসোল সংশোধনাগার থেকে বার করা হয় অনুব্রতকে। রাজ্য পুলিশের তত্ত্বাবধানে তাঁকে তোলা হয় গাড়িতে। প্রাথমিক গন্তব্য কলকাতা। নাটকের সেই শুরু। অনুব্রত বেরিয়ে যেতেই সেখানে ঢাক, ঢোল নিয়ে হাজির বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা। সংশোধনাগারের সামনে গোবরজল দিয়ে ‘শুদ্ধিকরণ’ করেন তাঁরা। এর পর সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট নাগাদ পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড়ের ‘ল্যাংচা কুঠি’তে এসে দাঁড়ায় কেষ্টর গাড়ি। তাঁকে ঘিরে আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের সঙ্গে ছিল পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশের নিরাপত্তা। অনুব্রত তখন দৃশ্যত ক্লান্ত। মনমরাও। সেখানেই সারেন জলযোগ। দোকানের এক কর্মী জানান, অনুব্রত চারটে ডালকচুরি, তরকারি, ছোলার ডাল, স্পেশাল ল্যাংচা এবং রাজভোগ দিয়ে প্রাতরাশ সেরেছেন।

Advertisement

এই জলখাবার খাওয়ার সময় হয় একপ্রস্ত নাটক। অনুব্রত যখন শক্তিগড়ের ল্যাংচার দোকানে প্রাতরাশ সারছিলেন, তখন তাঁর খাবার টেবিলে দু’জন যুবক ছিলেন। ওই দু’জনের সঙ্গে বারে বারে অনুব্রতকে দেখা যায় ‘শলাপরামর্শ’ করতে। অনুব্রতের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে ছিলেন গেঞ্জি পরা এক যুবক। আর অনুব্রতের পাশে বসে ছিলেন অন্য এক যুবক, যাঁর পরনে ছিল সবুজ পাঞ্জাবি। ওই যুবকই সকলের জলখাবারের বিল মেটান। জানা যায়, সবুজ পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তি ছাড়াও বাকি যে দু’জন ছিলেন, তাঁদের এক জনের নাম তুফান মিদ্দা। তিনি অনুব্রতের মেয়ে সুকন্যা মণ্ডলের গাড়িচালক। তৃতীয় জনের পরনে ছিল কালো ফুল স্লিভ শার্ট। সূত্রের খবর, তিনি আসানসোল জেল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি। ওই তিন জনকেও অনুব্রতের সঙ্গে জলখাবার খেতে দেখা যায়। কী ভাবে এক জন বিচারাধীন বন্দির সঙ্গে বাইরের লোকজন দেখা করল, কথা বলল এবং কেন একজন তৃতীয় ব্যক্তি খাবারের দাম মেটালেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

সকাল ১১টা নাগাদ কলকাতায় পৌঁছন অনুব্রত। তাঁকে জোকার ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হয় তাঁর স্বাস্থ্যপরীক্ষা। চিকিৎসকেরা ‘ফিট’ সার্টিফিকেট দেন। অনুব্রত পার করেন দিল্লি যাওয়ার আর এক ধাপ।

এর পর বিমানবন্দরে এসে শুরু হয় আর একপ্রস্ত নাটক। অনুব্রত দাবি করেন, তাঁর শরীর খারাপ লাগছে। বেশ কয়েক বার ইনহেলারও নেন। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলেও জানান। ইডি যদিও এই পর্বে কোনও বিবৃতি দেয়নি। তবে অনুব্রতের শারীরিক পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আগে থেকেই ঠিক ছিল, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫-এর বিমানে অনুব্রতকে নিয়ে দিল্লি যাবে ইডি। সেই মতো সন্ধ্যায় ওই বিমানে অনুব্রতকে তোলা হয়। সন্ধ্যা ৬টা ৫৭ মিনিট নাগাদ কলকাতা থেকে অনুব্রতকে নিয়ে উড়ে যায় সেই বিমান। সেখানে তাঁর দু’পাশে ছিলেন দু’জন ইডি আধিকারিক। বিমানের একেবারে পিছনের আসনে বসেছিলেন তাঁরা। মাথা নিচু করে বসেছিলেন বীরভূমের এক কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুব্রত। বিমানে তাঁর জন্য চিকিৎসকও ছিলেন। সন্ধ্যা ৭টা ২১ মিনিট নাগাদ বিমান বাংলার আকাশসীমা ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

রাত ৮টা ৫৪ মিনিট নাগাদ দিল্লি বিমানবন্দরে নামে বিমানটি। বেশ কিছু ক্ষণ পর দেখা যায়, অনুব্রত হেঁটে হেঁটে আসছেন। সঙ্গে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর জনা দশেক জওয়ান। তবে বেশি দূর হাঁটতে পারেননি সিওপিডিতে ভোগা অনুব্রত। সঙ্গে সঙ্গে আনা হয় হুইল চেয়ার। ইডি, চিকিৎসক এবং নিরাপত্তারক্ষীদের ঘেরাটোপে হুইল চেয়ারে বসেই বাইরে আসেন তিনি।

রাত ৯টা ২০ মিনিট। অনুব্রতকে নিয়ে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে যায় ইডি। সেখানে শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষার পর ইডি সূত্রে জানা যায়, আর দেরি করতে চায় না কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সশরীরে না হলেও ভার্চুয়ালিই তারা মঙ্গলবার রাতে অনুব্রতকে রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টের বিশেষ সিবিআই আদালতে হাজির করাতে চায়। শুরু হয় প্রস্তুতি। ঠিক হয়, রাত ১১টা ২০ নাগাদ ভার্চুয়াল মাধ্যমে বিচারক রাকেশ কুমারের এজলাসে শুরু হবে শুনানি।

সেই শুনানি শুরু হতেই আবার একপ্রস্ত নাটক। বিচারক রাকেশ কুমারের এজলাসে আধ ঘণ্টা শুনানি চলতে না চলতেই তা স্থগিত হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত হয়, ইডি এবং অনুব্রত মণ্ডল— দু’পক্ষই বিচারক রাকেশ কুমারের বাড়িতে যাবে। সেখানেই হবে শুনানি। এর পর অনুব্রতকে নিয়ে ইডি দফতরের অন্য গেট দিয়ে বেরিয়ে যায় গাড়ি।

কিন্তু কোথায় বিচারকের বাড়ি? শুরু হয় মহানাটক। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ‘চোরাগোপ্তা’ খেলার পর অবশেষে রাত ১টা নাগাদ অশোকবিহারে বিচারকের বাড়ি পৌঁছন অনুব্রত-সহ ইডি আধিকারিকেরা। রাত ১টার পর শুরু হয় সওয়াল।

আগেই অনুব্রতকে ১৪ দিনের জন্য বিচারবিভাগীয় হেফাজতে চেয়েছিল ইডি। পাল্টা অনুব্রতের আইনজীবী তাঁর মক্কেলের সারা দিনের ধকলের প্রসঙ্গ তোলেন। ইডির আইনজীবী দাবি করেন, গরু পাচারের টাকা কোথায় গিয়েছে, সেই টাকার ভাগ কারা কারা পেয়েছে তা জানতে অনুব্রতকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করা প্রয়োজন। শেষমেশ বিচারক ৩ দিনের ইডি হেফাজতের নির্দেশ দেন। বিচারক জানান, আগামী ১০ মার্চ পর্যন্ত অনুব্রত ইডির হেফাজতে থাকবেন। এই সময়ে তাঁকে রুটিন করে হাসপাতালে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি, অনুব্রত তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য সময় পাবেন প্রতি দিন আধ ঘণ্টা। রাত ১টা ৪৫ মিনিট নাগাদ শেষ হয় মহানাটক। একই সঙ্গে শেষ হয় প্রায় ১৯ ঘণ্টা ধরে চলা অনুব্রতের দোল-দিবস।

তবে মঙ্গলবার দুপুরে কলকাতা পৌঁছানোর আগে থেকেই অনুব্রত ছিলেন একেবারেই নীরব। যে তৃণমূল নেতার একের পর এক নিদান, মন্তব্যে বিতর্ক হয়েছে, শোরগোল পড়েছে রাজ্য রাজনীতিতে, তিনি মঙ্গলবার ‘টুঁ শব্দ’টি করেননি। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছেন। দিল্লিতে বিচারকের সামনেও তাঁর মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোয়নি। তা সে ভার্চুয়াল হোক বা সামনাসামনি।

গরু পাচার মামলায় গত অগস্ট মাসে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হন অনুব্রত। তার আগে সিবিআইয়ের হাতেই গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁর দেহরক্ষী সহগল হোসেন। সহগলকে পরে ইডি নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল। একই ভাবে গত বছরের নভেম্বরে অনুব্রকেও সিবিআইয়ের কাছ থেকে অনুব্রতকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ইডি। সহগলও আসানসোল সংশোধনাগারে বন্দি ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে দিল্লি নিয়েও যাওয়া হয়। এখন তিনি তিহাড় জেলে। ইডির হাতে অনুব্রতের গ্রেফতারির পর অনুব্রতকেও দিল্লি নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিল ইডি। আইনি মারপ্যাঁচ কাটিয়ে এত দিনে তারা বাংলা থেকে দিল্লি নিয়ে যেতে পেরেছে অনুব্রতকে। মঙ্গলবার সকালে শুরু হয়েছিল অনুব্রতের দিল্লি যাত্রা। ১৯ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার মধ্যরাতে সেই অনুব্রতকেই দিল্লিতে তিন দিনের জন্য ইডি হেফাজত পাঠালেন বিচারক।

Advertisement
আরও পড়ুন