(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম। —ফাইল চিত্র।
পুরসভার বাজেট বিতর্কে অংশ নিয়ে তৃণমূল কাউন্সিলর অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘যৌনগন্ধী’ মন্তব্য করায় ‘ক্ষুব্ধ’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা পুরসভার সূত্রের খবর, বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে আসার পর এ বিষয়ে তিনি কঠোর পদক্ষেপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন ফিরহাদ হাকিমকে। ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অনন্যাকে যাতে আর পুর অধিবেশনে বক্তৃতা করার সুযোগ না দেওয়া হয়, সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সোমবার কলকাতা পুরসভার বাজেট বিতর্কে অংশ নিয়ে অনন্যা একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেন। সন্ধ্যায় দলীয় কাউন্সিলরের ওই মন্তব্যের কথা জানতে পারেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ফোন করেন মেয়রকে। সূত্রের খবর, ভৎর্সনা করে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী অনন্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন মেয়রকে।
তার পরেই নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে এই বিষয়ে মেয়র ফিরহাদ লেখেন, ‘‘আজ পুরসভায় বাজেট বক্তৃতায় পুর প্রতিনিধি অনন্যা বন্দ্যেপাধ্যায়ের কিছু মন্তব্য সমাজের এক সম্প্রদায়ের মানুষকে আঘাত করেছে। আমি এই বিষয়ে অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে জানাচ্ছি যে, ওঁর এই মতের সঙ্গে দল একমত নয় এবং দলের পক্ষ থেকে এর তীব্র নিন্দা করে হচ্ছে। ওঁর কাছে তৃণমূল কংগ্রেস পুর দলের পক্ষ থেকে এই বক্তব্যের জবাবদিহি চাওয়া হয়েছে।’’ সোমবার বিতর্কিত মন্তব্যের পরে মঙ্গলবার অধিবেশনে যোগ দেননি অনন্যা। পুরসভা সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর মেয়রের দফতর থেকে ফোন করে অনন্যাকে বাজেট অধিবেশনে না আসার নির্দেশ পাঠানো হয়। সেই নির্দেশ মতোই মঙ্গলবার আর পুরসভার বাজেট অধিবেশনে আসেননি তিনি। যদিও প্রথমে মেয়রের এক্স হ্যান্ডলের মন্তব্যকে তত গুরুত্ব দিতে চাননি অনন্যা। আনন্দবাজার অনলাইনকে অভিনেত্রী-কাউন্সিলর বলেছিলেন, ‘‘সমাজমাধ্যমে মেয়র কী লিখেছেন দেখেছি। জবাব দেওয়ার কী আছে আমি জানি না। আমি যা বলার প্রকাশ্যেই বলেছি। তবুও ভেবে দেখব।’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘আমার বাক্স্বাধীনতা আছে। দলের কোনও মতামত থাকতেই পারে। আমি কোনও অন্যায় করিনি। যে কথা নিয়ে বিতর্ক, তা বলার আগে বলেওছিলাম, এটা রূপক মাত্র। কাউকে আঘাত করার জন্য নয়।’’
তবে মেয়রের দফতর থেকে ফোন পাওয়ার পর অনন্যা দলনেত্রীর মনোভাবের কথা জানতে পেরেছেন। তাই ওই বিতর্কিত মন্তব্য প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে আর কোনও বক্তব্য পেশ করেননি অনন্যা। তবে তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, কাউন্সিলর হওয়ার পাশাপাশিই বিভিন্ন চ্যানেলে দলের মুখপাত্র হিসাবে অংশ নিতেন অনন্যা। তাঁর বক্তব্যে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ভাবাবেগ আহত হয়েছে, এই কারণে তাঁকে চ্যানেলে যাওয়ার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে। তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, এক ‘প্রভাবশালী’ মন্ত্রী অনন্যার জন্য লোকসভা নির্বাচনে টিকিটের জন্য দলের অন্দরে দরবার করতে শুরু করেছিলেন। পুরসভার ঘটনার পরে সেই উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। পাশাপাশিই, সন্দেশখালিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী শিখ সম্প্রদায়ের পুলিশ আধিকারিককে ‘খলিস্তানি’ বলে আক্রমণ করছেন বলে অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নেমেছে তৃণমূল। তার ‘মোকাবিলা’ করতে অনন্যার যৌনগন্ধী মন্তব্যকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে বিজেপি। বিরোধী শিবিরের হাতে আক্রমণের ‘অস্ত্র’ তুলে দেওয়া নিয়েও অনন্যার বিরুদ্ধে দলের একাংশে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে বলে দলের নেতারাই ঘরোয়া আলোচনায় বলতে শুরু করেছেন।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার বাজেট বিতর্কে অংশ নিয়ে পশ্চিমি সংস্কৃতিতে ‘ফাদার’ এবং ‘নান’দের (সন্ন্যাসিনী) সম্পর্ক নিয়ে নানা গল্পের কথা উল্লেখ করেন অনন্যা। এর পরে একটি গল্পও শোনান। সেই ‘যৌনগন্ধী’ গল্পে বাইবেলের ১১২ নম্বর অধ্যায়ে ‘গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও’ বাণী রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন ওই কাউন্সিলর। সেই সময়েই প্রতিবাদ ওঠে বিজেপির তরফে। ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর সজল ঘোষ এবং ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর বিজয় ওঝা অনন্যার মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন। ঘটনাচক্রে, ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুস্মিতা ভট্টাচার্যর সঙ্গেও অনন্যার বাদানুবাদ হয়। সুস্মিতা বলেন, ‘‘ফাদার-নানের সম্পর্কে ‘সেক্স’ শব্দটি উচ্চারণ করে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ করেছেন অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ প্রসঙ্গত, সুস্মিতা এবং ১৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর ক্রিস্টিনা বিশ্বাস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। দলের দুই কাউন্সিলর যখন তাঁর বিরুদ্ধে এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তখন সামগ্রিক ভাবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে বলেই মনে করছেন দলের নেতৃত্ব। মনে করছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। তাই অনন্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ‘যুক্তিযুক্ত’ বলেই দলের অন্দরে মনে করা হচ্ছে।