উত্তপ্ত সন্দেশখালি। —ফাইল চিত্র।
সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের মাটি আঁকড়ে থেকেই বাংলা থেকে বামফ্রন্টকে সরানোর জমি মজবুত করেছিল তৃণমূল। এ বার সন্দেশখালির মাটিকে লোকসভা ভোটের ‘ঘাঁটি’ বানাতে চায় বিজেপি। বামফ্রন্টের দুর্গে ফাটল ধরাতে যে ভাবে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই পথেই হাঁটতে চায় পদ্মশিবির।
সন্দেশখালি নিয়ে ইতিমধ্যেই একের পর এক কর্মসূচি নিয়েছে রাজ্য বিজেপি। বিভিন্ন কমিশন সন্দেশখালি আসায় তার থেকেও ফায়দা তুলতে চেয়েছে তারা। সেই ধারাই চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে পদ্মশিবিরের। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, সেটা চান দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও। সেই নির্দেশকে কাজে লাগাতে পরিকল্পনাও পাকা বঙ্গ বিজেপির। সন্দেশখালিতে গিয়ে বা সন্দেশখালিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের রেশ ধরে রেখেই লোকসভা ভোটে আসনসংখ্যা বাড়াতে চায় তারা। আপাতত রবিবার পর্যন্ত কর্মসূচি তৈরি হয়ে গিয়েছে। সে সবের সঙ্গে বৃহস্পতিবারই রাজ্য বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি শাখার তৈরি ‘দ্য বিগ রিভিল– দ্য সন্দেশখালি শকার’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
সন্দেশখালি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই লাগাতার কর্মসূচি চলছে। মাঝে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার-সহ দলের নেতারা প্রায় সকলেই দিল্লিতে দলের ‘রাষ্ট্রীয় অধিবেশন’-এ যোগ দিতে গিয়েছিলেন। বুধবার সকালেই সুকান্ত দিল্লি থেকে ফিরেছেন। বৃহস্পতিবার যাচ্ছেন সন্দেশখালির পুলিশ জেলা বসিরহাটে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মঙ্গলবার গিয়েছিলেন সন্দেশখালিতে। সেখানে গিয়ে অবশ্য পুলিশের সঙ্গে বিবাদ এবং ‘খলিস্তানি’ বিতর্কে জড়ান বিজেপি নেতৃত্ব। এ বার সেই ‘খলিস্তানি’ বিতর্ক থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে আবার সন্দেশখালিকে ঘিরে রাজনৈতিক আবহ বদলাতে মরিয়া বিজেপি। শুভেন্দু রবিবার আবার সন্দেশখালি যেতে পারেন বলেও জানা গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ ফেব্রুয়ারি সন্দেশখালিতে তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের বাড়িতে হানা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) আধিকারিকেরা। তার পর থেকেই ধীরে ধীরে সেখানে জনবিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। তৃণমূল নেতা শাহজাহান-সহ তাঁর দুই শাগরেদ শিবু হাজরা ও উত্তম সর্দারের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ করতে শুরু করেন সন্দেশখালির মহিলারা। সন্দেশখালিতে তফসিলি সম্প্রদায়ের মহিলাদের উপরে যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগও ওঠে। এ ছাড়াও তোলাবাজি, চাষের জমি কেড়ে ভেড়ি তৈরি-সহ নানাবিধ অভিযোগ উঠতে শুরু করে। যার জেরে ‘অস্বস্তি’তে পড়ে শাসক তৃণমূল। শিবু ও উত্তমকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশ। কিন্তু এখনও বেপাত্তা শাহজাহান। তাঁর গ্রেফতারির দাবিতে রোজই কোথাও না কোথাও আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। যার জেরে এখনও পর্যন্ত সন্দেশখালিতে শান্তি ফেরেনি। দফায় দফায় ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে পুলিশকে। তা নিয়ে আবার আদালতে গিয়েছে বিজেপি। এই ঘটনা পরম্পরায় তৃণমূল ‘অস্বস্তি’-তে পড়েছে বলেই দাবি প্রধান বিরোধী দল বিজেপির। ফলে তারা সেই পরিস্থিতিকে যথাসম্ভব জিইয়ে রাখতে চায়।
জাতীয় তফসিলি কমিশনের প্রতিনিধিদল সন্দেশখালিতে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে গিয়ে বাংলায় ৩৫৬ ধারা জারির সুপারিশও করে এসেছে। দু’দফায় গিয়েছে জাতীয় মহিলা কমিশনও। দ্বিতীয় দফায় কমিশনের চেয়ারম্যান রেখা শর্মা রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারির পরিস্থিতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। রাজনৈতিক ভাবেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। ন্যাজাট থানায় গিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙেছেন সুকান্ত ও তাঁর অনুগামীরা। সন্দেশখালি ঢোকার চেষ্টা করায় টাকিতে পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হন। সরস্বতী পুজোর দিন সেই আন্দোলনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় সুকান্তকে।
বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার সুকান্ত যাবেন বসিরহাট সংশোধনাগারে। সেখানে বন্দি সন্দেশখালির বিজেপি নেতা বিকাশ সিংহ-সহ ১০ জন পদ্মশিবিরের নেতা-কর্মী। বৃহস্পতিবার সুকান্তের পাশাপাশি জাতীয় আদিবাসী কমিশনের প্রতিনিধিদলেরও সন্দেশখালি যাওয়ার কথা। বুধবারেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাজ্য প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে সন্দেশখালির রিপোর্ট চেয়েছে চার সপ্তাহের মধ্যে। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিদলও খুব তাড়াতাড়ি সন্দেশখালি যেতে পারে।
মঙ্গলবার শুভেন্দু সন্দেশখালি যেতে পারলেও আগে দু’বার তিনি বিজেপি বিধায়কদের নিয়ে পথেই আটকে গিয়েছিলেন। শেষমেশ কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে তিনি সন্দেশখালি যেতে পারেন। সেখানে আবার যাবেন বলে বাসিন্দাদের আশ্বাস দিয়ে এসেছেন বিরোধী দলনেতা। আগামী শুক্রবার বিজেপির মহিলা মোর্চার সভানেত্রী ফাল্গুনী পাত্রের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সন্দেশখালি যাবে। তার পরের দিন হবিবপুরের বিধায়ক জোয়েল মুর্মুর নেতৃত্বেও বিজেপির আদিবাসী নেতারা যাবেন সন্দেশখালি। প্রসঙ্গত, জোয়েল বিজেপির তফসিলি উপজাতি মোর্চার রাজ্য সভাপতিও। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতি থেকে রবিবার কর্মসূচি তৈরি হয়ে গেলেও তার পরে কী কী করা যায়, তা নিয়ে দলে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। তার আগে পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তার উপরে নজর রেখে তবেই পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করবেন বলে মনস্থ করেছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব।