—প্রতীকী চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোট সংক্রান্ত মামলার পাহাড় জমছে কলকাতা হাই কোর্টে। সপ্তাহের প্রথম দিনই এ সম্পর্কিত অন্তত ৭৩টি মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল আদালতে। কিন্তু সময়ের অভাবে সবগুলি মামলা শুনতে পারেননি বিচারপতিরা। এতগুলো মামলায় দৃশ্যত বিরক্তও হন প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম। পরিস্থিতি এমনই হয় যে, সব মামলার শুনানি স্থগিত করে দেওয়ারও হুমকিও দেন তিনি। যদিও তার পরেও সোমবার এক দিনে অন্তত ৪০টি মামলার শুনানি হয়েছে হাই কোর্টে। এক একটি মামলার শুনানিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে ভর্ৎসনাও করেন বিচারপতিরা। যেমন একটি মামলার শুনানিতে বিচারপতি অমৃতা সিংহ বলেন, ‘‘এ বার কি হাই কোর্টকেই নির্বাচন করাতে হবে?’’
পঞ্চায়েত ভোটের এতগুলো মামলার মাঝে নতুন আবেদন শুনে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম। সোমবার উচ্চ আদালতে পঞ্চায়েতের একগুচ্ছ মামলার শুনানি ছিল। তার মধ্যে প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞাানমএবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের যৌথ বেঞ্চেই ছিল প্রায় ২৬টি জনস্বার্থ মামলা। এ ছাড়া বিচারপতি অমৃত সিংহের এজলাসে ১২টি মামলার শুনানি ছিল। তার মধ্যে ব্যালট সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে কমিশনকে উদ্দেশ্য করে বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন বিচারপতি সিংহ।
পঞ্চায়েত ভোটে একটি ভোটের ব্যবধান প্রার্থীর ভাগ্য বদলে দিতে পারে। সেখানে পঞ্চায়েত ভোটে একটি বুথে বাতিল হয়েছে ৩১৯টি ব্যালট পেপার। সোমবার এই অভিযোগ শুনে বিস্মিত হন বিচারপতি সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘এটা কি ছেলেখেলা চলেছে? এত ভুল হলে নির্বাচন করারই দরকার নেই।’’ বিচারপতি এ-ও বলেন, ‘‘হঠাৎ করে এত ব্যালট পেপার বাতিল হয়ে গেল কী করে? বার বার এত ভুল হলে নির্বাচন করারই দরকার নেই।’’
উল্লেখ্য, পুরুলিয়ার ঝালদা-১ নম্বর ব্লকের একটি বুথে দ্বিতীয় বার গণনা করার সময় ৩১৯টি ব্যালট পেপার বাতিল হয়ে যায়। বিরোধী প্রার্থীদের অভিযোগ ছিল, ওই ঘটনার সময় কোনও প্রার্থী গণনাকেন্দ্রে ছিলেন না। আগেও মামলাটির শুনানি হয় বিচারপতি সিংহের এজলাসে। সেখানে ওই এলাকার বিডিওর রিপোর্ট তলব করেছিল আদালত। সোমবার সেই রিপোর্ট ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে আদালতে। মামলাকারীর অভিযোগে সত্যতা রয়েছে বলেও জানতে পেরেছে আদালত। এর পরেই সোমবার নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কড়া মন্তব্য করেন বিচারপতি। তিনি জানতে চান, ‘‘দ্বিতীয় বার গণনা করা হয়েছিল কার নির্দেশে। বিডিও কি চোখ বন্ধ করে ছিলেন?’’
প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানমের এজলাসে অন্তত ২৪টি মামলার শুনানি হয়েছে সোমবার। বেশির ভাগ মামলায় কোনও নির্দেশ আসেনি। বেশ কয়েকটি মামলা শুনানির জন্য এজলাসে ওঠেওনি। বিচারপতি জয় সেনগুপ্তের এজলাসে পঞ্চায়েত সংক্রান্ত অন্তত তিনটি মামলার শুনানি হয়েছে। বেশ কয়েকটি মামলার শুনানি হয়েছে বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিচারপতি অপূর্ব সিংহ রায়ের এজলাসে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলায় নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে ১০ দিন
রাজ্যে আরও ১০ দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে। কেন্দ্রের তরফে তেমনটাই জানানো হয়েছে কলকাতা হাই কোর্টকে। তার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের বেঞ্চের নির্দেশ, এই ১০ দিনে কোথাও কোনও অশান্তি হলে সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে হবে। রাজ্যের পরিস্থিতি বিবেচনা করে হাই কোর্টের তরফে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মেয়াদ বৃদ্ধি করার বিষয়টি কেন্দ্রকে বিবেচনা করে দেখতে বলা হয়েছিল। আরও এক মাস বাংলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখা যায় কি না, কেন্দ্রের কাছে জানতে চেয়েছিল হাই কোর্ট। সেই মামলাতেই কেন্দ্র জানিয়েছে, আরও ১০ দিন রাজ্যে বাহিনী থাকবে।
বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটের ফল ঘোষণার পরেও ১০ দিন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে রাজ্যে থাকার নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। আদালত জানিয়েছিল, ভোটের ফল জানার পরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা যাতে সুনিশ্চিত করা যায়, সেই কারণেই এই নির্দেশ। কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশের পরেও রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে অশান্তি এবং হিংসার খবর আসতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ১০ দিন পর কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে গেলে সন্ত্রাস আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আদালতে আবেদন করেছিলেন আইনজীবী তথা বিজেপি নেত্রী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের বেঞ্চ জানায়, ভোটের ফল প্রকাশের পরে প্রথম ১০ দিনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আরও রাখতে হলে কেন্দ্রের মতামত নিতে হবে। কেন্দ্র আরও ১০ দিন রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার সিদ্ধান্ত আদালতকে জানিয়েছে।
পুনর্গণনা সংক্রান্ত মামলা
কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৬৯৬টি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে এখনই কোনও নির্দেশ দিচ্ছে না আদালত। সমস্ত অভিযোগ এবং সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া হবে।
মহিলাদের হেনস্থার অভিযোগ
পঞ্চায়েত ভোটের সময় এবং ভোট পরবর্তী সময়ে মহিলাদের উপর হিংসার অভিযোগ উঠেছে রাজ্যের নানা প্রন্তে। বেশির ভাগ অভিযোগই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ, রাজ্যে বিজেপির মহিলা কর্মী এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থন করায় মহিলারা আক্রান্ত হচ্ছেন, এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিজেপি মহিলা সাংসদদের নিয়ে গঠিত তথ্যানুসন্ধান দলও পাঠিয়েছে বাংলায়। সোমবার মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনায় আদালতের পর্যবেক্ষণ এবং নির্দেশ রয়েছে। প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দেন, যে মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের নিরাপদে বাড়ি ফেরানোর দায়িত্ব নিতে হবে স্থানীয় থানার পুলিশকে। সেই সঙ্গে পুলিশ সুপারের তদারকিতে অভিযোগগুলির তদন্ত করতে বলেছে আদালত।
বিচারপতিদের অসন্তোষ
পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্ব থেকেই হিংসার সূত্রপাত হয়েছে। নির্বাচন সংক্রান্ত হিংসায় এখনও পর্যন্ত ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে শুধু ভোটের দিনের সংঘর্ষেই প্রাণ হারিয়েছেন ২২ জন। শাসক এবং বিরোধী দলের সদস্যেরা এই তালিকায় রয়েছেন। এ ছাড়া, ভোটে কারচুপি, অশান্তির অভিযোগেও বহু মামলা আদালতে ওঠে। আগেও পঞ্চায়েতের এত মামলা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। সোমবার নতুন করে বিরক্তির কথা জানান তিনি। কিন্তু পঞ্চায়েত সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা মোটেও কমেনি। উল্টে বেড়েই চলেছে। আইনজীবীদের একাংশের ধারণা, পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা থেকে এত দিন পর্যন্ত মামলার সংখ্যা অনায়াসে শতাধিক পার করে দিয়েছে। তবে এক দিনে পঞ্চায়েতের ৭৩টি মামলা শুনানির তালিকায় রয়েছে, এর আগে এমনটা দেখা যায়নি। এই সংক্রান্ত একটি মামলায় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এটা গুরুতর অভিযোগ। এ বিষয়ে কিছু করা প্রয়োজন।’’ আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে সমস্ত অতিরিক্ত হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।