দলে আধুনিকতার সঙ্গে অভিজ্ঞতার মিশেল চাইছেন সুকান্ত মজুমদার। ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি রাজ্য বিজেপিতে দু’টি বদল এসেছে। রাজ্য কর্মসমিতির সদস্য প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায় দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির শীর্ষে বসেছেন। আবার সহ-সভাপতি পদে থাকা সঞ্জয় সিংহকে দলের কল সেন্টারের ইনচার্জ করা হয়েছে। দীর্ঘ দিন গেরুয়া রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এই দুই নেতার হাতে এত দিন সে ভাবে কোনও দায়িত্বই ছিল না। তাঁদের দায়িত্ব দিয়ে কি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দলের ‘আদি’ নেতাদের গুরুত্ব বাড়াতে চাইছেন? এমন প্রশ্ন উঠছে বিজেপির অন্দরেই। যদিও সুকান্তের দাবি, এটা তাঁর একার সিদ্ধান্ত নয়, সকলের মতামত নিয়েই দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টন হয়। তবে তিনি যে পুরনো নেতাদের কাজে লাগিয়ে কাছে টানতে চান তা-ও স্পষ্ট সুকান্তের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘‘সংগঠন মজবুত করতে হলে আধুনিকতার সঙ্গে অভিজ্ঞতার মিশেল দরকার হয়। বিজেপি তাতেই বিশ্বাস করে। তাই কে পুরনো, কে নতুন, সেটা বিবেচ্য নয় আমার কাছে। কারা কাজের মানুষ সেটাই প্রাধান্য পায়।’’
গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে অন্য দল থেকে অনেক নেতাই বিজেপিতে এসেছিলেন। তখনই ‘আদি’ বনাম ‘নব্য’ বিজেপির লড়াই দেখা যায়। পরে সুকান্ত রাজ্য সভাপতি হয়ে কিছু বদল আনলেও পুরনোদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলেই দলের ভিতরে অভিযোগ উঠতে শুরু করে। এখন যেন সেই অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন সুকান্ত।
রাজ্য বিজেপিতে গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় পর্যন্তও প্রতাপের গুরুত্ব ছিল খুব বেশি। তখন তিনি সহ-সভাপতি পদে। রাহুল সিংহ রাজ্য সভাপতি থাকার সময়ে রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রতাপ। দিলীপ ঘোষের জমানাতেও তিনি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। সুকান্ত সভাপতি হওয়ার পরে যে রাজ্য কমিটি তৈরি হয় তাতে বাদ পড়েন প্রতাপ। তাঁকে শুধুই রাজ্য কর্মসমিতিতে রাখা হয়। এ বার সুকান্তই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির আহ্বায়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলেন। এত দিন বিজেপির শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধান ছিলেন বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকার। ২০২০ সালে শেষ বার এই কমিটি তৈরি হয়েছিল। তবে সুভাষ কেন্দ্রের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরে দলের দৈনন্দিন সাংগঠনিক কাজে থাকতে পারছিলেন না। এ বার ওই কমিটিকে ফের কার্যকর করতে চাইছে রাজ্য বিজেপি। প্রতাপ ছাড়াও ওই কমিটিতে রাখা হয়েছে, ব্রজেশ ঝা, মৌসুমি বিশ্বাস এবং ক্ষুদিরাম টুডুকে। ওই তিন জনই দলের পুরনো দিনের নেতা। ক্ষুদিরাম গত বিধানসভা নির্বাচনে বাঁকুড়ার রানিবাঁধ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। পরাজিত হন চার হাজারের কম ভোটে। তিনি বিজেপির জনজাতি মোর্চার জাতীয় সম্পাদকের পদে থাকলেও রাজ্যে কোনও দায়িত্বে ছিলেন না। নিয়ে এলেন সুকান্ত।
কল সেন্টারের ইনচার্জ হওয়া সঞ্জয়ও বিজেপির পুরনো নেতা। রাহুল এবং দিলীপের সময়ে রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সুকান্তের আমলে সহ-সভাপতি হলেও কোনও দায়িত্বে ছিলেন না। গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সঞ্জয়কে মাথায় বসিয়েই বিজেপি কল সেন্টার শুরু করল। এখানে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা প্রায় সকলেই বেতনভুক কর্মী। এর আগে সে ভাবে কল সেন্টারের কোনও ইনচার্জ না থাকলেও গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকে কাজ দেখছিলেন রাজ্য সম্পাদক দীপাঞ্জন গুহ। এ বার সেখানে সঞ্জয়ের সহকারি হিসাবে রাখা হয়েছে আর এক পুরনো দিনের নেতা কিশোর করকে। অতীতে কিশোর বিজেপির কলকাতা উত্তর শহরতলি জেলার সভাপতি ছিলেন। তবে আরও এক জন সহায়ক হয়েছেন তুলনামূলক ভাবে অনেক পরে বিজেপিতে আসা অবসরপ্রাপ্ত মেজর ঋত্বিক পাল। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে বিজেপি যে হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছিল তা সামলানোর দায়িত্বে অন্যদের সঙ্গে ঋত্বিকও ছিলেন।
লোকসভা নির্বাচনের আগে দলের পুরনো নেতাদের গুরুত্ব দিয়ে কাজে ফেরানোর চেষ্টা যে বিজেপি করছে তার নিদর্শন রয়েছে আরও একটি সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে। কয়েক মাস আগে বীরভূমের বিজেপি নেতা দুধকুমার মণ্ডল জেলা ও ব্লকস্তরের কমিটিতে বদল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। ফেসবুকে লেখেন, ‘‘ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থক এবং কার্যকর্তাগণ, আমাকে যাঁরা ভালবাসেন তাঁরা চুপচাপ বসে যান।’’ এর পরেই তাঁকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেয় রাজ্য বিজেপি। কিন্তু তিনি পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলে তাতে অনুমোদন দেন সুকান্ত। দুধকুমার চার বার বিজেপির টিকিটে গ্রাম পঞ্চায়েত এবং এক বার পঞ্চায়েত সমিতিতে জয়ী হন। এই বারেও তিনি ময়ূরেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ওই পঞ্চায়েতে বিজেপির ফলও ভাল হয়েছে। কারণ দর্শানোর চিঠি পাওয়ার পরেও দুধকুমারের মতো আদি নেতার দাবি মেনে নেওয়াকে অনেকেই সুকান্তের ‘কাজের লোককে কাছে টানা’র উদ্যোগ বলে মনে করেছিলেন। আর তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া অন্য নেতারাও কি ফের গেরুয়া শিবিরের কাছাকাছি আসবেন? লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার সাংগঠনিক দায়িত্ব পেতে পারেন?
গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে বিজেপির থেকে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল আরও কয়েক জন নেতার। সায়ন্তন বসুকে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরে কোনও দায়িত্ব বা কোনও কমিটিতেই রাখা হয়নি। সায়ন্তন বিজেপিতে থাকলেও রাজ্য দলের সঙ্গে যথেষ্টই দূরত্ব তাঁর। আবার সহ-সভাপতি পদে থাকলেও রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর বিজেপির কোনও কর্মসূচিতেই দেখা যায় না। ইদানীং, দলের সব বৈঠকে ডাকও পান না তিনি। এ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে রাজুর। বিধানসভা নির্বাচনের পরে দলবিরোধী মন্তব্য করার জন্য জয়প্রকাশ মজুমদার এবং রীতেশ তিওয়ারিকে ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়। এর পরে জয়প্রকাশ তৃণমূলে যোগ দিলেও রীতেশ সে সব কিছু করেননি। একটা সময়ে রাজ্য বিজেপির অন্যতম প্রধান মুখপাত্র রীতেশ অতীতে নির্বাচনেও লড়েছেন। এখন পুরনোদের গুরুত্ব দেওয়া শুরু হওয়ায় রাজ্য বিজেপি তথা সুকান্ত কি রাজু, সায়ন্তন, রীতেশের মতো পুরনো নেতাদের কাজে লাগানোর কথাও ভাববেন? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবিরের অন্দরে।
শুধু রাজ্য স্তরেই নয়, জেলায় জেলায় একটা সময়ে বিজেপির হয়ে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা অনেক নেতাই গুরুত্ব না পেয়ে বসে গিয়েছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্বে তাঁরা রাস্তায় নামেননি। লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবার পুরনো ভূমিকায় ফিরতে বলা হতে পারে বলেও গেরুয়া শিবির সূত্রে জানা গিয়েছে। এতে খুশি দিলীপও। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি বলেন, ‘‘খুবই ভাল। যাঁরা যোগ্য তাঁদের যোগ্য দায়িত্ব দেওয়া হলে দলেরই উন্নতি হবে। এত দলে ভারসাম্য থাকবে। পুরনো নেতারা দলের রীতি নীতি জানেন। কাজের পাশাপাশি নতুনদের শেখাতেও পারবেন।’’
তবে সুকান্ত বা তাঁর অনুগামী নেতারা চাইলেও সে কাজ খুব সহজ হবে না বলেই মনে করছেন রাজ্যের অনেক বিজেপি নেতা। কারণ, রাজ্য বা জেলা স্তরে যে সব পুরনো নেতার সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাঁদের অনেককে নিয়ে নানা কারণে রাজ্যের শীর্ষ নেতাদের কারও কারও আপত্তি রয়েছে। কোনও কোনও নেতাকে নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের কর্তারা বা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আপত্তি জানাতে পারেন।