—নিজস্ব চিত্র।
সরকারি নিয়মে রাসমঞ্চে রাস উৎসব নিষিদ্ধ হওয়ায় তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্যত্র। কিন্তু মল্লরাজা বীর হাম্বিরের আমলে চালু হওয়া রাস উৎসব আজও উন্মাদনা আর আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় শুধু মল্ল রাজধানী নয়, সমগ্র মল্লভূমের মানুষকে।
কথিত আছে, এক সময় বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা ছিলেন শাক্ত। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে ৪৯তম মল্লরাজা বীর হাম্বির শ্রীনিবাস আচার্যর সান্নিধ্যে এসে বৈষ্ণব ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। বীর হাম্বির নিজে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পাশাপাশি বৈষ্ণব ধর্মকে মল্লভূমের রাজধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় থেকেই রাধাকৃষ্ণ প্রেমে মশগুল হয়ে ওঠে মল্ল গড় বিষ্ণুপুর সহ গোটা মল্লভূম। এই সময় থেকেই রাজকোষের অর্থব্যয়ে গড়ে উঠতে শুরু করে একের পর এক অপরুপ টেরাকোটার মন্দির। কথিত আছে, বৈষ্ণব ধর্মের জোয়ারে এক সময় বিষ্ণুপুরে এত সংখ্যক মন্দির তৈরি হয়েছিল যে, সান্ধ্যপ্রদীপ দিতে রাজকোষ থেকে প্রতি দিন একমণ ঘি বরাদ্দ করতে হয়েছিল। এই মন্দিরগুলির অধিকাংশই ছিল রাধাকৃষ্ণের মন্দির। মন্দিরের সংখ্যা ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি বিষ্ণুপুরের আবেগ লক্ষ্য করে সেই সময় বিষ্ণুপুরকে অনেক ঐতিহাসিক গুপ্ত বৃন্দাবন হিসাবে চিহ্নিত করেন।
বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি রাজা-সহ সাধারণ মানুষের এই আবেগ যেখানে, সেখানে রাস উৎসব হবে না, তা হয় না কি? কথিত আছে, রাজা বীর হাম্বির বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর রাজ অর্থানুকূল্যে বিষ্ণুপুরে শুরু হয় রাস উৎসব। উৎসব পালনের জন্য নগরীর কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত হয় সুদৃশ্য ও সুবিশাল রাস মঞ্চ। সে সময় রাস পূর্ণিমার দিন রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মন্দিরগুলি থেকে বিগ্রহ নিয়ে এসে সাজিয়ে রাখা হত রাস মঞ্চে। তার পর স্বয়ং রাজা, তাঁর পরিবারের সদস্যেরা এমনকি আপামর প্রজারা রাস পূর্ণিমার পর থেকে টানা কয়েক দিন ধরে রাসমঞ্চের সামনে উৎসবে মেতে থাকতেন। কালের নিয়মে বিষ্ণুপুরের সেই রাস উৎসবের আয়োজনে আর রাজকীয় আভিজাত্য নেই, কিন্তু সাড়ে তিনশো বছরের গরিমা ও কৌলিন্য বুকে নিয়ে আজও রাস উৎসব আয়োজিত হয়ে আসছে বিষ্ণুপুরে। বর্তমানে পূরাতত্ত্ব দফতর রাস মঞ্চকে হেরিটেজ সাইট হিসাবে চিহ্নিত করায় সেখানে আর রাস উৎসবের অনুমতি মেলে না। কিন্তু অতীতের রীতি মেনে শুক্রবার সন্ধ্যায় বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন মন্দির থেকে বিগ্রহ এনে রাখা হয় মাধবগঞ্জ ও কৃষ্ণগঞ্জের দু’টি মন্দিরে। সেখানেই ভক্তি সহকারে পুজো পাঠ হয়। রীতি মেনে এই পুজো পাঠ চলবে রাস পূর্ণিমা থেকে টানা পাঁচ দিন। উৎসবকে ঘিরে মেলাও বসে ওই দুই মন্দির প্রাঙ্গণে। শুধু বিষ্ণুপুর শহর বা মল্লভূমের মানুষ নয়, সুপ্রাচীন এই উৎসব দেখতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকেরাও ভিড় জমিয়েছেন বিষ্ণুপুরে।
বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান গৌতম গোস্বামী বলেন, ‘‘এক সময় যখন রাসমঞ্চে রাস উৎসব হত, সে সময় বিষ্ণুপুরের অন্যান্য মন্দিরের বিগ্রহের মতোই মাধবগঞ্জর রাধা মদন গোপাল জিউ ঠাকুরের মন্দির থেকেও বিগ্রহ রাসমঞ্চে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু বর্তমানে রাসমঞ্চে উৎসবের অনুমতি না মেলায় মাধবগঞ্জের রাধা মদন গোপাল জিউ এর মন্দিরেই এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। কৃষ্ণগঞ্জেও এই রাস উৎসব হয়। চলতি বছর ৪০ জোড়া বিগ্রহ মন্দিরে আনা হয়েছে। প্রতি বছরের মতো ৫ দিন ধরে এই উৎসব চলবে। প্রথম দিন থেকেই মানুষের ভিড় প্রমাণ করছে গুপ্ত বৃন্দাবন এই বিষ্ণুপুরে রাস উৎসবের প্রতি মানুষের কতটা আবেগ রয়েছে।’’