Arnab Dam

কেন অর্ণবকে এখনই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে দিতে চান না? বর্ধমানের উপাচার্য জবাব দিলেন সেই বিতর্কের

জেলবন্দি মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইতিহাস নিয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডির প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছিলেন। গত শুক্রবার পরীক্ষার ফলাফলে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
বর্ধমান শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ১৬:৫৭
(বাঁ দিকে) অর্ণব দাম। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম চন্দ্র (ডান দিকে)।

(বাঁ দিকে) অর্ণব দাম। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম চন্দ্র (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

প্রবেশিকা পরীক্ষার পরে ইন্টারভিউতে প্রথম হওয়া সত্ত্বেও জেলবন্দি মাওবাদী নেতা অর্ণব দামকে পিএইচডি করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ‘অনাবশ্যক জটিলতা’ তৈরি করার অভিযোগ তুলে ময়দানে নেমেছে তৃণমূল। তবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম চন্দ্রের দাবি, তিনি চান অর্ণব তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি করুন। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি জানিয়েছেন, দু’টি প্রশ্নের সদুত্তর মিললেই যাবতীয় ‘জটিলতা’ কেটে যাবে।

Advertisement

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অর্ণব দীর্ঘ দিন ধরেই হুগলি জেলা সংশোধনাগারে বন্দি। ছাত্রজীবনে মেধাবী পড়ুয়া হিসাবে পরিচিত অর্ণব জেলে বসেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা সেট-এ উত্তীর্ণ হন। তার পরে জেল থেকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে গিয়ে পিএইচডির প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তার পরেও অবশ্য গবেষণার কাজ শুরু করতে পারেননি তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই চান না জেলবন্দি অর্ণব পিএইচডি করার সুযোগ পান, এই মর্মে বিতর্ক এবং জল্পনা তুঙ্গে, তখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে তাঁর এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ‘অবস্থান’ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কথায়, “আমি হুগলির জেল সুপারকে চিঠি দিয়ে দু’টি প্রশ্ন করেছিলাম। প্রথম প্রশ্ন, কী ভাবে অর্ণব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিয়মিত ক্লাস করবেন? সে ক্ষেত্রে তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি কে বা কারা দেখবেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, অর্ণবকে পিএইচডি করতে দেওয়ার বিষয়ে জেল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অনুমোদন রয়েছে কি না।” উপাচার্য জানান, ওই দু’টি বিষয়ের ‘সদুত্তর’ না মেলায় অর্ণবের পিএইচডিতে ভর্তির বিষয়টি শুরু করা যাচ্ছে না।

ওই বিষয়ে নিজের ‘সদিচ্ছা’র দিকটিও ব্যাখ্যা করেন উপাচার্য। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯টি বিভাগের মধ্যে কেবল ইতিহাস ছাড়া অন্যগুলিতে পিএইচডিতে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা হুগলি জেলের সুপারকে দেওয়া চিঠির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছি।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “অর্ণব ইন্টারভিউয়ে প্রথম হয়েছেন। তাঁকে বাদ দিয়ে আমরা ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি না।”

অর্ণব যে বিষয় নিয়ে পিএইচডি করবেন, সেই ইতিহাস বিভাগ অবশ্য পুরো বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উপরে ছেড়েছেন। ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ তনভীর নাসরিন বলেন, “আমরা একেবারে প্রস্তুত। অর্ণবের ভর্তি প্রক্রিয়া মিটে গেলেই আমরা ক্লাস শুরুর অপেক্ষায় আছি।”

তবে অর্ণবকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের একাংশের মধ্যে ‘অস্বস্তিও’ রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বিতর্কের প্রেক্ষিতে সেটি কেউই প্রকাশ্যে বলতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি সূত্রের খবর, একটা সময়ে ‘একে ৪৭’ রাইফেল নিয়ে ঘোরা অপরাধীর পিএইচডি করা নিয়ে আপত্তি রয়েছে কিছু অধ্যাপকের। এমনকি, পড়ুয়াদের একাংশও নাকি ওই বিষয়ে নিজেদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। পুলিশকে নিয়ে জেলবন্দি অপরাধী পিএইচডির ক্লাস করতে গেলে অন্য পড়ুয়াদের মনে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়েও চিন্তিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একাংশ।

তবে উচ্চশিক্ষায় গবেষণার ক্ষেত্রে এক জন গবেষককে ‘নিয়মিত’ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে কেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি ব্যাখ্যা করে উপাচার্য বলেন, “পিএইচডির ক্ষেত্রে আমাদের ছ’মাসের একটা কোর্স আছে। এই কোর্সে প্রত্যেক গবেষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে হাজির থাকতে হয়। এর অনুমতি অর্ণব পাবেন কি না জানি না।” তা ছাড়াও উপাচার্য জানিয়েছেন, গবেষণাপত্র জমা দিতে হয় তিন থেকে ছ’বছরের মধ্যে। দীর্ঘস্থায়ী এই প্রক্রিয়ার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন উপাচার্য। তবে তাঁর আশ্বাস, গবেষণার ক্ষেত্রে অন্য গবেষকদের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় সাহায্য পাবেন অর্ণব।

বৃহস্পতিবার সকালেই অর্ণবকে পিএইচডি করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে সরব হন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করে কুণাল লেখেন, ‘‘মাওবাদী অভিযোগে বন্দি অর্ণব দামকে পিএইচডি করতে দিতে হবে। ও যোগ্যতা প্রমাণ করেছে।... উপাচার্য অকারণ জট তৈরি করে বাধা দিচ্ছেন।’’ ঘটনাটি নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভূমিকায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও ‘ক্ষুব্ধ’ বলে খবর শিক্ষা দফতর সূত্রে। ব্রাত্য এবং রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরি এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। যাতে প্রয়োজনে অর্ণবকে হুগলি জেল থেকে বর্ধমান জেলে নিয়ে আসা যায়। সে ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত সহজতর হতে পারে। জেলবন্দি অর্ণবকে পিএইচডির প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার জন্য বহু লড়াই লড়তে হয়েছে।

এককালে খড়্গপুর আইআইটির মেধাবী ছাত্র অর্ণব পড়াশোনা ছেড়ে সিপিআই (মাওবাদী)-এর রাজনৈতিক মতবাদে আকৃষ্ট সেই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সফরে ইতি পড়ে শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করার পরে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে যাবজ্জীবন সাজা হয় অর্ণবের। জেলবন্দি অবস্থাতেই আদালতের কাছে পিএইচডি করার অনুমতি চান তিনি। যদিও কার্যক্ষেত্রে সেই ইচ্ছাপূরণে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। সেই ‘যুদ্ধে’ জিতে পরীক্ষাতেও প্রথম হয়েছেন অর্ণব। কিন্তু তার পরে আবার বাধার সম্মুখীন তিনি। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদ শাখাও অর্ণব-সহ ইতিহাস বিভাগের প্রবেশিকা পরীক্ষায় সফল পড়ুয়াদের দ্রুত ভর্তি করানোর দাবিতে সরব হয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement