নীল রঙের তিন তলা বাড়ির নীচের তলায় বাবা-ছেলের ক্লিনিক। —নিজস্ব চিত্র।
এক জনের নামের পাশে ডিগ্রি হিসাবে লেখা ‘এমবিবিএস’। অন্য জনের নামের পাশে ডিগ্রি লেখা নেই, তবে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘জেনারেল ফিজিশিয়ান’। দু’জনের কেউই অবশ্য ডাক্তারি পাশ করেননি। কিন্তু জমিয়ে বাড়িতে ডাক্তারির ‘ব্যবসা’ করতেন। সম্পর্কে তাঁরা বাবা-ছেলে। বর্ধমান শহরে এমনই দুই ভুয়ো চিকিৎসককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শনিবার তাঁদের তোলা হচ্ছে আদালতে।
দু’দিন আগেই একটি অনুষ্ঠান থেকে বর্ধমানে বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেনিয়মের অভিযোগ করে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন স্থানীয় বিধায়ক খোকন দাস। এমনকি, সিএমওএইচকে ঘেরাওয়ের হুমকিও দেন। ঘটনাচক্রে, তার পরেই গ্রেফতার হলেন দুই ভুয়ো ডাক্তার। বর্ধমান শহরের লক্ষ্মীপুর মাঠ এলাকায় একটি নীল রঙের বাড়ির নীচের তলায় ‘ডাক্তারখানা’। তাতে রোগী দেখেন একে প্রসাদ এবং ডিকে দীপক। সম্পর্কে তাঁরা বাবা-ছেলে। একে প্রসাদের নামের পাশে লেখা, ‘এমবিবিএস’। ডিকে দীপকের নামের পাশে লেখা জেনারেল ফিজিশিয়ান। পিতা-পুত্রের পসার ভালই। শুক্রবার যখন ওই বাড়িতে পুলিশ পৌঁছয়, তখনও জনা দশেক রোগী অপেক্ষা করছিলেন ডাক্তার দেখাবেন বলে। কিন্তু দু’জনেই ভুয়ো চিকিৎসক বলে অভিযোগ। তাঁরা যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই ‘ক্লিনিক’ চালু করেছেন। সেখানে ছোটখাটো অস্ত্রোপচারও হয়। চিকিৎসা করার ন্যূনতম ডিগ্রি না থাকার পরেও ‘পারিবারিক ভাবে ডাক্তার’ পিতা-পুত্র। স্থানীয় সূত্রে খবর, দুই ‘ডাক্তার’ সম্পর্কে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন ওই এলাকার কয়েক জন বাসিন্দা। তার পরেই নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। শুক্রবার পুলিশ খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন বা ক্লিনিকের নথি, অভিযুক্তদের কাছে সে সব কিছুই নেই। এর পরই বাবা-ছেলেকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, একটি তিনতলা বাড়ির মালিক ধৃতেরা। বাড়ির একতলায় তাঁদের ক্লিনিক ছিল। কিন্তু ডাক্তারির ডিগ্রি ছিল না কারও। বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে একটি ওষুধের দোকান। সেটি আবার ধৃত ‘এমবিবিএস চিকিৎসকের’ ছোট ছেলের। ভুয়ো কাগজ নিয়ে ডাক্তার সেজে লোক ঠকানোর অভিযোগে বাবা-ছেলেকে শনিবার আদালতে তোলা হচ্ছে। জানা যাচ্ছে, এর আগে ২০১৭ সালে ধৃতদের এক জন পুলিশের জালে ধরা পড়েছিলেন। কিন্তু ছাড়া পেয়ে আবার জমিয়ে ডাক্তারি শুরু করেন। ধৃত একে প্রসাদ জানান তাঁর পুরো নাম অশোককুমার প্রসাদ। তাঁর দাবি, তিনি ছোট থেকে বিহারে পড়াশোনা করেছেন। সেখানকার কলেজে পড়াশোনা শেষ করে সিএমএস, সিডিপি (কমিউনিটি মেডিক্যাল সার্ভিস) সংক্রান্ত ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু ওই ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসা করা যায় কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযুক্ত জানিয়েছেন, একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সহকারী হিসাবে কাজ করতেন। ছেলে বাড়িতে ক্লিনিক চালু করেন। তার পর থেকে ছেলের ক্লিনিকেই ‘প্র্যাকটিস’ শুরু করেন তিনি। কিন্তু নামের পাশে কেন ভুয়ো ডিগ্রি লেখা, তার কোনও জবাব দিতে পারেননি প্রসাদ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চিকিৎসার মতো মহান পেশাকে পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত করেছেন বাবা-ছেলে। নির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা করছেন তাঁরা। শুক্রবার ওই ক্লিনিকে প্রচুর চিকিৎসার সরঞ্জাম পাওয়া গিয়েছে। মুর্শিদাবাদ থেকে চিকিৎসা করাতে আসা এক রোগিণী জানান, তিনি ১০ দিন ধরে সেখানে চিকিৎসাধীন। রোগিণীর আত্মীয় সালমা বিবি বলেন, ‘‘মায়ের প্যারালিসিসের চিকিৎসার জন্য এখানে এনেছি।’’
দুই ভুয়ো চিকিৎসকের গ্রেফতারি নিয়ে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জয়রাম হেমব্রম বলেন, ‘‘বর্ধমানের লক্ষ্মীপুর মাঠে এই ক্লিনিক সম্পর্কে এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ জানিয়েছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগের বিষয়ে বর্ধমান থানায় জানানো হয়েছে। উল্লেখিত চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে কি না, সেই বিষয়টি মেডিক্যাল কাউন্সিলকে জানানো হবে। ক্লিনিক বা চিকিৎসাকেন্দ্র পরিচালনা ক্ষেত্রে বৈধ অনুমোদন রয়েছে কি না, পুলিশ তার খোঁজ নিচ্ছে।’’