পুজোয় পশ্চিমবঙ্গবাসীর পাতে ইলিশ কি উঠবে! — ফাইল চিত্র।
দীর্ঘ টালবাহানার অবসান। পুজোয় এ বার পশ্চিমবঙ্গবাসীর পাতে পড়বে বাংলাদেশি ইলিশ। দুর্গাপুজোর আগে একটু-আধটু নয়, বাংলাদেশের ইলিশ আসছে তিন হাজার টন!
শনিবার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রক একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেখানে। কিন্তু বাংলাদেশের ইলিশ বাজারে এলেও মধ্যবিত্ত কি তার নাগাল পাবে? এ বাংলার বাজারে পদ্মার এক কেজি ইলিশের দাম কত হবে? সে সব নিয়ে এখন বাঙালির কৌতূহল। এর আগে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছিল, উৎসবের মরসুমে এ পার বাংলায় ইলিশ পাঠানো হবে না। শেষ মুহূর্তে কেন সেই সিদ্ধান্ত বদল হল তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টাতেই কি মত-বদল? কূটনীতিবিদদের একাংশের মতে, উৎসবের আবহে ভারতকে ইলিশ না পাঠানোর সিদ্ধান্তে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছিল। যার প্রভাব পড়তে পারত দু’দেশের সম্পর্কে। বাংলাদেশ সরকার শনিবারের সিদ্ধান্তে কূটনৈতিক ভাবে সব দিকই সামাল দিল বলেই মনে করছেন ওই অংশ।
তবে মৎস্য ব্যবসায়ীরা ‘কূটনীতি’ নিয়ে আপাতত ভাবতে নারাজ। পদ্মার ইলিশ এ দেশে আসছে, সেই মাছ বাঙালির হেঁশেল অবধি পৌঁছে দিতে হবে, আপাতত তার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রস্তুতি সেরে রাখছে ভারতের ‘ফিশ ইম্পোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন’ (মৎস্য আমদানি সংগঠন)। ওই সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে, উৎসবের জন্য প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ পার বাংলায় ইলিশ চলে আসে। এ বছর তা এখনও আসেনি। শনিবার বাংলাদেশ সরকার ইলিশ পাঠানোর ছাড়পত্র দেওয়ায় খুশি ‘ফিশ ইম্পোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন’। সংগঠনের সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মকসুদ বলেন, ‘‘মাছ আসছে নিশ্চিত। একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এখন সেই জটিলতা কেটে গিয়ে ইলিশ আসছে। আমরা খুশি। উৎসবের মরসুমে পদ্মার ইলিশ এ বঙ্গের বাঙালির পাতে পড়বে।’’
এর আগে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছিল, উৎসবের মরসুমে ভারতে ইলিশ রফতানি বন্ধ রাখা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানানো হয়েছিল। নেপথ্যে অন্য কোনও কারণ নেই বলেও জানিয়েছিল মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। শনিবার বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, দুর্গাপুজোর আগে তিন হাজার মেট্রিক টন ইলিশ পাঠানো হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, ভারতের যে সকল ব্যবসায়ী মাছ আমদানির জন্য আগে আবেদন করেছিলেন, তাঁদের আর নতুন করে আবেদন করার প্রয়োজন নেই। তবে নতুন করে যাঁরা আবেদন করতে চান, তাদের আগামী ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে হবে। ইলিশ আমদানির প্রক্রিয়া নিয়ে যদিও ভাবতে রাজি নয় এ বঙ্গের বাঙালিরা। তাদের কাছে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, বাজারে গিয়ে পদ্মার এক কেজি ইলিশ কত দিয়ে কিনতে হবে? ফিশ ইম্পোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদকের কথায়, ‘‘মাছের দাম কত কী হবে, বলা এখনই সম্ভব নয়। এমনিতেই ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। যদি পরিমাণে বেশি আসে, তবেই দাম কম হবে। নয়তো দাম বেশিই থাকবে।’’
শনিবার ঢাকার খুচরো বাজারে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশের দাম ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় কেজি প্রতি প্রায় ১,৭০০ টাকা। এমনিতে ১,৭০০ থেকে ২,২০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এ পারের ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, সেই মাছ যখন আড়তদারের হাত ঘুরে এ পারের বাজারে আসবে, তখন প্রতি কেজির দাম হতে পারে ভারতীয় মুদ্রায় ২,২০০ থেকে ২,৫০০ টাকা। প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে দাম। গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আমদানি করেছিল ভারত। গত বার এক কেজির কম ওজনের মাছের দাম ছিল ভারতীয় মুদ্রায় কেজি প্রতি ৭০০ টাকা। এক কেজির বেশি ওজনের দাম ছিল কেজি প্রতি প্রায় ১,২০০ টাকা। সেই তুলনায় এ বার যে দাম বৃদ্ধি পাবে তা নিয়ে মৎস্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংশয় নেই।
তবে কি এত বেশি দামে বাংলাদেশ থেকে এ বছর মাছ কিনতে রাজি হবেন এ পারের আমদানিকারীরা? আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের ফিশারি অ্যাসোসিয়েশন এবং আসাদুন্নবি ফিশারিজ অ্যান্ড মার্চেন্ট কর্পোরেশনেরও। ইলিশ রফতানির জন্য এই দুই সংগঠইন মূলত দরপত্র ডাকে। কারণ হিসাবে তারা জানাচ্ছে, বৈধ পথে না ঢুকলেও এ দেশে বাংলাদেশের ইলিশের ছড়াছড়ি। সূত্রের দাবি, সীমান্ত পেরিয়ে আকছার অনুপ্রবেশ করে ইলিশও। এই সময় দুই বাংলার মধ্যে বয়ে চলা নদীগুলিতে পাট পচাতে দেওয়া হয়। সেই পচা পাটের সঙ্গেই বেঁধে দেওয়া হয় ইলিশের বস্তা। বিএসএফের নজর এড়িয়ে এ দেশে ঢুকে পড়ে ইলিশ। সেগুলি প্রায় ১,২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। ফিশারি অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্যের আশঙ্কা, ‘‘বৈধ পথে যাওয়া ইলিশ কি আর কেউ বেশি দাম দিয়ে কিনতে চাইবেন?’’
এর আগে ইলিশ চেয়ে বাংলাদেশে চিঠি পাঠিয়েছিল ভারতের ‘ফিশ ইম্পোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন’। সেই চিঠির প্রসঙ্গ তুলেই দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশের মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গবাসীকে শারদীয়ার শুভেচ্ছা। কিন্তু দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে এ বার ও পার বাংলায় ইলিশ পাঠাতে পারব না আমরা।’’ তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ যাতে ইলিশ মাছ কিনে খেতে পারেন, সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু ভারত নয়, কোনও দেশেই ইলিশ রফতানি করছে না বাংলাদেশ। ফরিদা এ-ও জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে এখন ইলিশের জোগান কম। এখন ইলিশ রফতানি হলে দেশের বাজারে ঘাটতি দেখা যাবে। সেটা তাঁরা চান না। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করেও এখনও পর্যন্ত এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম হাজার টাকার মধ্যে আনতে পারিনি। এই অবস্থায় আমাদের অক্ষমতা স্বীকার করে ভারত এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছি।’’
কিন্তু আচমকাই সেই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন ঘটিয়ে ইলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানানো হল। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কি কূটনৈতিক কারণ রয়েছে? কারণ, এর আগে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তিকালীন সরকার দাবি করেছিল, ইলিশের মতো ‘ক্ষুদ্র ইস্যু’ ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কে কোনও প্রভাব ফেলবে না। ভারত থেকে ডিম আমদানির পরে আলু এবং পেঁয়াজ রফতানি স্বাভাবিক রাখার আর্জিও জানায় ইউনূসের সরকার। কিন্তু শনিবার ইলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেখে কূটনীতিবিদদের একাংশ মনে করছেন, দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতেই এই পদক্ষেপ করেছে ইউনূস সরকার। দিন দুই আগেই ফরিজা বলেছিলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ইলিশের জন্য প্রভাবিত হবে না। কিন্তু বন্ধুদেশের মনে সৌজন্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই ভেবে দেখছি।’’ ইউনূস বলেছিলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করব না। ওরা আমাদের একমাত্র প্রতিবেশী দেশ, যাদের সঙ্গে আমরা সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছি।’’ বাংলাদেশের কূটনীতিকদের একাংশেরও মনে হয়েছিল, উৎসবের আবহে ভারতকে ইলিশ না পাঠানো ‘ঔদ্ধত্য’ দেখানো হতে পারে। তার প্রভাব পড়তে পারে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তিতেও। মনে করা হচ্ছে সেই সব ‘কূটনৈতিক’ কারণকে মাথায় রেখেই বাংলাদেশ সরকার পুজোর আগে তিন হাজার টন ইলিশ পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে।