সোমবারের মিছিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ছবি টুইটার।
দু’দিন আগে কালীঘাটের বাড়িতে মুর্শিদাবাদ জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলার ৪২টি আসনেই লড়বে তৃণমূল। কিন্তু সেই বৈঠক ছিল চার দেওয়ালের ভিতরে। সোমবার জনস্রোতের সংহতি মিছিল শেষে পার্ক সার্কাসের সভা থেকে প্রকাশ্যেই মমতা বুঝিয়ে দিলেন, ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদের সঙ্গে বাংলায় তাঁর দলের ‘সংহতি’ হওয়া মুশকিল। সিপিএম তো নয়ই, কংগ্রেসকেও যে ভাবে আক্রমণ করলেন মমতা, তা-ও রাজনৈতিক ভাবে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী জোটের কথা উল্লেখ করে সোমবার মমতা বলেন, ‘‘আমি নাম দিয়েছিলাম ‘ইন্ডিয়া’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, বৈঠকে গেলে দেখতে পাই বৈঠকটা সিপিএম বৈঠক!’’ এর পরেই মমতা বলেন, ‘‘৩৪ বছর সিপিএমের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে লড়েছি। ওদের কোনও পরামর্শ শুনব না!’’ সিপিএমের পাশাপাশি নাম না করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও আক্রমণ শানান তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী। মমতার কথায়, ‘‘আমি বলেছিলাম, যে রাজ্যে, যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী, তারা সেই রাজ্যে লড়ুক। আর আপনারা ৩০০ আসনে একা লড়াই করুন। আমরা সাহায্য করব। তারা বলছে, তাদের মর্জিমতো হবে।’’
জোটের ক্ষেত্রে যারা এই ‘নেতিবাচক’ ভূমিকা নিচ্ছে বলে মমতা মনে করছেন, তাদের উদ্দেশে তিনি বিজেপিকে সাহায্য করার অভিযোগ তুলেছেন। মমতা বলেছেন, ‘‘তোমরা (পড়ুন সিপিএম এবং কংগ্রেস) বিজেপিকে সাহায্য করলে আল্লাহর কসম, কেউ তোমাদের ক্ষমা করবে না!’’ স্পষ্ট করেই মমতা বলেন, ‘‘বাংলায় তৃণমূলের একা লড়ার হিম্মত রয়েছে। কিন্তু ওরা লড়তে দিচ্ছে না।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই মমতার ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘গোটা দেশ জানে বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে মমতার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সলিল চৌধুরীর একটা গানের লাইন ধার করে বলতে ইচ্ছে করছে, তৃণমূল নেত্রী হয়তো গাইছেন, এই রোকো, ইন্ডিয়ার গাড়িটা থামাও, আমি নেমে যাব।’’ আর তৃণমূলনেত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা কটাক্ষের সুরে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, ‘‘ও আচ্ছা! ঠিক আছে, বুঝেছি।’’
এখনও মমতা রাস্তায় নামলে কী পরিমাণ লোক সমাগম হতে পারে, তা সোমবারের কলকাতা আরও একবার দেখেছে। মিছিল তো বটেই, পার্ক সার্কাসের সভাতেও ছিল ঠাসা জমায়েত। তবে অনেকেই বলছেন, তৃণমূল শাসকদল হওয়ায় মিছিল ‘সংগঠিত’ করতে পেরেছে। অনেকের মতে, মিছিলের ভিড়ে ‘তৃপ্ত’ মমতা একপ্রকার বুঝিয়েই দিলেন, তিনি বাংলার ৪২টি আসনেই একা লড়ার দিকে এগোতে চান।
রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, মমতার এই বার্তা আসলে কংগ্রেস হাইকমান্ডের উদ্দেশে। কারণ, তাঁদের সঙ্গেই বাংলায় আসন সমঝোতার ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা এগিয়েছিল। এক দিকে কংগ্রেসের দর কষাকষি এবং অন্য দিকে বঙ্গ কংগ্রেস নেতাদের ‘তৃণমূল অ্যালার্জি’ বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। বস্তুত, মমতা মুম্বইয়ের ‘ইন্ডিয়া’ বৈঠকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ৩১ অক্টোবরের মধ্যে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে চান। কিন্তু তখন বিষয়টিতে কংগ্রেসও খুব একটা গা করেনি। কারণ, ডিসেম্বরে পাঁচ রাজ্যের ভোট ছিল। তার পর দেখা যায় কংগ্রেস রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে হারতেই ফের ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়ে। গত ১৯ ডিসেম্বর জোট বৈঠকে মমতা দাবি করেছিলেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে চান। নইলে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা-ও হয়নি। সব দিক থেকেই তাঁর ‘একা’ লড়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল। দু’দিন আগে ঘরোয়া বৈঠকের পরে সোমবার প্রকাশ্য সভা থেকেই ‘একলা চলা’র ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন বাংলার দিদি।