Mamata Banerjee Congress

‘ইন্ডিয়া’য় চাপে কংগ্রেস? মমতা নিজের অবস্থান জানিয়ে দিতেই খুলে গেল নানা শরিকের নানা মুখ

মমতা সরাসরি বলে দিয়েছেন বাংলায় তাঁর দল তৃণমূল একাই লড়বে। যা হওয়ার, ভোটের পরে দেখা যাবে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বিষয়ে তাঁর কোনও কথা হয়নি বলেও দাবি মমতার।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:৫৭

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

প্রথমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চার দেওয়ালের মধ্যে কংগ্রেস সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তার পর গত সোমবার পার্ক সার্কাসের মঞ্চ থেকে নাম না করে রাহুল গান্ধীর দলের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘‘ওরা মর্জি মতো চলতে চাইছে।’’ কিন্তু বুধবার বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বিষয়টি ‘দিদি’ সরাসরি উড়িয়ে দিতেই বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র একাধিক শরিক দল মুখ খুলতে শুরু করল। তাতে সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসের উপর খানিকটা চাপ বাড়ল বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ।

Advertisement

মমতা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলায় তাঁর দল তৃণমূল একাই লড়বে। যা হওয়ার, ভোটের পরে দেখা যাবে। শুধু তা-ই নয়, তৃণমূলনেত্রী বুধবার পূর্ব বর্ধমানের প্রশাসনিক সভায় রওনা হওয়ার আগে এ-ও জানান, রাহুল গান্ধী যে বাংলায় আসছেন, তা-ও সৌজন্য দেখিয়ে তাঁকে জানানো হয়নি। যদিও এর আগে রাহুল এবং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে দাবি করেছিলেন, ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’য় ‘ইন্ডিয়া’র সমস্ত শরিকদলকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মমতার বুধবারের এই মন্তব্যের পরে কংগ্রেসের সঙ্গে পঞ্জাবের জোটের বিষয়ে অন্য সুর শোনা গিয়েছে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল আম আদমি পার্টির গলায়। পাশাপাশি, কেজরীর এক মন্ত্রী জানিয়েছেন, কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর জন্য বাংলায় মমতার সঙ্গে জোটের বিষয়টি ঘেঁটে গিয়েছে। পাল্টা অধীর বলেছেন, ‘‘আমি জানিই না, জোট নিয়ে কার সঙ্গে কখন, কবে আলোচনা হয়েছে।’’ তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছে এনসিপি এবং উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনাও। তবে বাংলায় মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের প্রকাশ্যে ‘দূরত্ব’ তৈরি হতেই, সেখানে সিপিএম জায়গা করতে চাইছে। এমনটা যে খুব অপ্রত্যাশিত, তা-ও নয়। বৃহস্পতিবার রাহুলের যাত্রা কোচবিহার দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করবে। সেখানে প্রতিনিধি পাঠাবে সিপিএম। বুধবার রাতে আনন্দবাজার অনলাইনকে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জীবেশ সরকার সেখানে যাবেন। থাকবেন কোচবিহারের নেতারাও।’’

কংগ্রেস নিয়ে মমতা

বুধবার কংগ্রেস প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে মমতা বলেন, ‘‘কারও সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। আমার প্রস্তাব প্রথম দিনেই প্রত্যাখ্যান করেছে! আমার সঙ্গে কারও কোনও আলোচনা হয়নি। অ্যাবসোলিউটলি মিথ্যা কথা!’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই যে আমাদের রাজ্যে আসছে (রাহুলের যাত্রা), আমাকে তো এক বারও বলেনি!’’ মমতার কথায়, ‘‘আমরা আঞ্চলিক দলগুলো ভোটের পরে কী সিদ্ধান্ত নেব, তা ভোটের পরেই ঠিক করব। আমি তো ওদের (কংগ্রেসকে) বলেছিলাম ৩০০ আসনে লড়তে। বাকিটা আমরা সকলে মিলে লড়তাম।” বস্তুত, মমতার বুধবারের মন্তব্যে এ-ও স্পষ্ট যে, তিনি ‘ইন্ডিয়া’র অন্দরে কংগ্রেসকে এক দিকে এবং অন্য আঞ্চলিক দলগুলিকে আর এক দিকে রাখছেন। সোমবার পার্ক সার্কাসের মঞ্চ থেকে মমতা ‘ইন্ডিয়া’র সমালোচনা করেছিলেন। কংগ্রেসের নাম না করেও বলেছিলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী, তারা সেই রাজ্যে লড়ুক। আর আপনারা ৩০০ আসনে একা লড়াই করুন। আমরা সাহায্য করব। তারা বলছে, তাদের মর্জিমতো হবে।’’

মঙ্গলবার রাহুল মমতার সম্পর্কে যা বলেছিলেন

মমতার সোমবারের বক্তব্য নিয়ে মঙ্গলবার রাহুলকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে কংগ্রেস নেতা বলেছিলেন, ‘‘আমাদের (কংগ্রেস-তৃণমূলের) যে আসন বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া রয়েছে, তা চলছে। তার ফল আসবে। ওই বিষয়ে আমি এখানে কোনও মন্তব্য করব না।’’ কিন্তু প্রায় একশ্বাসে রাহুল বলেছিলেন, ‘‘মমতাজির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ও দলের সম্পর্ক (রিস্তা) খুবই ভাল। হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই রকম (বিতর্ক) হয়। আমাদের কেউ কিছু বলে দেন। ওঁদের কেউ কিছু বলেন। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সে সব এতে (আসন বোঝাপড়ায়) বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।’’ গত সপ্তাহে মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূল নেতৃত্বকে নিয়ে কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠক করেছিলেন মমতা। ওই বৈঠকেই মমতা বলে দিয়েছিলেন, ৪২টি আসনে একা লড়াইয়ের প্রস্তুতি রাখতে হবে। এমনকি, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী সম্পর্কে জেলা নেতাদের মমতা বলেছিলেন, উনি কোনও ‘ফ্যাক্টর’ নন। ওঁর কথা মাথাতেই আনতে হবে না। অভ্যন্তরীণ বৈঠকের পাশাপাশি সোমবার প্রকাশ্যেও মমতা কংগ্রেসের সমালোচনা করেন। যদিও সে দিন তিনি কংগ্রেসের নাম করেননি। তবে কংগ্রেসকে মমতার আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ‘সন্তুষ্ট’ হয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। কারণ, তাঁরা মনে করছিলেন এর ফলে তৃণমূলের সঙ্গে জোটে যাওয়ার হাইকমান্ড-ইচ্ছা ধাক্কা খাবে। কিন্তু দেখা গেল স্বয়ং রাহুল জোটপ্রক্রিয়ায় নতুন ‘অক্সিজেন’ দিলেন।

জয়রাম রমেশের বক্তব্য

বুধবার বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা মমতা খারিজ করে দেওয়ার পরেও অবশ্য কংগ্রেস আশা জিইয়ে রাখতে চেয়েছে। সাংবাদিক বৈঠকে কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের নেত্রী। আর তৃণমূল ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।’’ জয়রামের দাবি, মমতার ‘পুরো বার্তা’ না জেনেই বিভিন্ন জায়গায় ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘মমতাজির পুরো বয়ান হল, ‘আমাদের বিজেপিকে হারাতে হবে। বিজেপিকে হারাতে এক কদমও পিছনে ফেলব না।’ সেই ভাবনা নিয়েই তো আমরা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছি।’’

আপের ফোঁস

মমতা মুখ খোলার পরেই দিল্লির মন্ত্রী তথা আপ মুখপাত্র সৌরভ ভরদ্বাজ বলেন, ‘‘তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গের বড় দল। কংগ্রেস এবং বামেরা ধারাবাহিক ভাবে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। এই পরিস্থিতিতে তাই আসন ভাগাভাগি একটু কঠিন হবেই।’’ এর পরেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকে দুষে তাঁর মন্তব্য, ‘‘অধীর চৌধুরী ধারাবাহিক ভাবে মমতা এবং তৃণমূল সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করে চলেছেন। তাঁকে ‘সুযোগসন্ধানী’ বলেছেন। যখনই সমঝোতা ইতিবাচক অবস্থানে পৌঁছয়, তখনই এমন বিতর্কিত মন্তব্য করা হচ্ছে।’’ পাশাপাশি, পঞ্জাবে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতার বিষয়টিও উড়িয়ে দেন সৌরভ। তাঁর কথায়, ‘‘পঞ্জাবে আমরা একার শক্তিতেই লড়ার এবং জেতার ক্ষমতা রাখি।’’ আপের একটি সূত্র জানাচ্ছে, দলের পঞ্জাব নেতৃত্বের তরফে ইতিমধ্যেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়ার বিষয়ে আপত্তির কথা জানানো হয়েছে কেজরীকে। অথচ মঙ্গলবারই জাতীয় সংবাদমাধ্যমে পঞ্জাবে আপ-কংগ্রেসের সমঝোতা ইতিবাচক বলে দাবি করা হয়েছিল।

এনসিপি ও শিবসেনার মন্তব্য

এনসিপি নেত্রী তথা শরদ পওয়ারের কন্যা সুপ্রিয়া সুলে ‘ইন্ডিয়া’য় মমতা তথা তৃণমূলের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিমত জানিয়েছেন। তবে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, এক একটি রাজ্যের বাস্তবতায়, এক এক রমক পরিস্থিতি হতেই পারে। আবার উদ্ধব ঠাকরের ছেলে তথা শিবসেনা (ইউবিটি) নেতা আদিত্য ঠাকরে বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির বিরুদ্ধে বাঘিনীর মতো লড়ছেন। তাঁকে বাদ দিয়ে বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ের কথা ভাবাটাই বাতুলতা।’’

আরও পড়ুন
Advertisement