হুগলি জেলা পরিষদের ৩৬ নম্বর আসন থেকে ২০১৮ সালে জিতেছিলেন বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
ইডির হাতে গ্রেফতার হয়ে বন্দি হুগলি জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কারিগরি এবং স্বাস্থ্য দফতরের কর্মাধ্যক্ষ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অপরাধে ইডি গ্রেফতার করার পরেই তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে তৃণমূল। সেই আসনে এ বার তৃণমূলের প্রার্থী দেবীপ্রসাদ রক্ষিত। তিনি আগেও পঞ্চায়েত ভোটে লড়েছেন। এত দিন গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য থাকা তৃণমূলের ‘আদি’ এই নেতার উপরেই এ বার শান্তনুর ছেড়ে যাওয়া আসন জেতার দায়িত্ব। অন্য দিকে, বিজেপি ভেবেচিন্তেই এই আসনে প্রার্থী করেছে একদা তৃণমূলে থাকা বাপ্পাদিত্য ঘড়ুইকে। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যোগ দিয়ে যুব মোর্চার রাজ্য কমিটির সদস্যও হয়েছেন তিনি। বিজেপির অভিযোগ, সরকারি চাকরির জন্য শান্তনুর কাছে আবেদন করেছিলেন বাপ্পাদিত্য। তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকা চান দলেরই শান্তনু। তবে সেই টাকা দিতে না পারায় চাকরি জোটেনি। আর তাতেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন বাপ্পাদিত্য।
হুগলি জেলা পরিষদের ৩৬ নম্বর আসনে লড়াই শুধু তৃণমূল বনাম বিজেপির নয়। দেবীপ্রসাদ বনাম বাপ্পাদিত্যেরও নয়। এই আসনের লড়াইয়ে আসলে জেলে থেকেও রয়েছেন শান্তনু। তারকেশ্বরের চাঁপাডাঙার বাসিন্দা তথা শিক্ষক প্রিয়তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যে তদন্ত চলছে তাতে হুগলি জেলার নাম এসেছে সবচেয়ে বেশি। আর তার সঙ্গে এই এলাকার নামও এসেছে। ফলে নির্বাচনে কেউ মুখে বলতে না চাইলেও শান্তনুর প্রসঙ্গ মানুষের মনে রয়েইছে। তবে তার প্রভাব ভোটে পড়বে কি না সেটা বলতে পারব না।’’ ভোটে প্রভাব পড়বে কি না অজানা থাকলেও সেই চেষ্টা পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। জেলার নেতারা ভোটের প্রচারে বার বার তুলছেন নিয়োগ দুর্নীতি প্রসঙ্গ। তুলছেন শান্তনুর পাশাপাশি এই জেলারই বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের কথাও। প্রসঙ্গত, নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কুন্তলও বর্তমানে বন্দি।
তারকেশ্বর এলাকার ৩৬ নম্বর আসন থেকে ভোটে জিতলেও শান্তনু ছিলেন হুগলির গুপ্তিপাড়ার বাসিন্দা। চাকরি করতেন রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন নিগমে। তবে ইডি দাবি করেছে, শান্তনুর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির হদিস মিলেছে তদন্তে। হোটেল, রিসর্ট-সহ কুড়িটি সম্পত্তির কথা জানা গিয়েছে বলেও দাবি তাদের। তবে গুপ্তিপাড়ায় বাড়ি হলেও শান্তনু রাজনীতি করতেন তারকেশ্বর, পুড়শুড়া এলাকায়। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বলে দাবি করেছেন বিজেপির বাপ্পাদিত্য। তিনি বলেন, ‘‘আমি চিনতাম। একই দল করায় যোগাযোগও ছিল। আমি গ্রুপ সি-র একটা চাকরির জন্য বলেছিলাম। তিনি আমার কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা চান। কিন্তু অত টাকা দেওয়ার সঙ্গতি আমার ছিল না। দিইনি। চাকরিও হয়নি। পরে আমি গোটা বিষয়টা বুঝতে পারি। এটাও জানতে পারি, গোটাটাই সংগঠিত ভাবে হচ্ছে। এর পরেই দল বদলে বিজেপিতে চলে যাই।’’
বাপ্পাদিত্যের সুরে বলছেন তৃণমূল প্রার্থী দেবীপ্রসাদও। তাঁরও দাবি দুই জনপ্রতিনিধির মধ্যে যেটুকু সম্পর্ক থাকা দরকার তার বাইরে শান্তনুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। দেবীপ্রসাদ বলেন, ‘‘শান্তনু আমার এলাকার জেলাপরিষদ সদস্য ছিলেন। আমি ছিলাম বালিগোড়ি-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। ফলে প্রয়োজনের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কোনও ঘনিষ্ঠতা ছিল না।’’ দেবীপ্রসাদ তৃণমূল করছেন দলের জন্মলগ্ন থেকেই। তিনি বলেন, ‘‘আগে কংগ্রেস করতাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন কংগ্রেস ছাড়েন সে দিন আমিও ছাড়ি। ১৯৯৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হই। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে জিতেছি।’’ দু’বার গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতলেও কখনও পঞ্চায়েত সমিতিতে লড়াই না-করা সেই দেবীপ্রসাদকে এ বার শান্তনুর ছেড়ে যাওয়া ‘কঠিন’ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে। তবে দেবীপ্রসাদ বলছেন অন্য কথা। তিনি বলেন, ‘‘বলাগড়ের বাসিন্দা হলেও শান্তনু এখান থেকে কেন প্রার্থী হতেন সেটা শীর্ষনেতারা বলতে পারবেন। তবে কোনও আসন কারও নামে হয় না। এখানে ভোট হবে দিদির নামে। তাঁর হাত শক্ত করতেই আমাদের সমর্থন দেবে মানুষ।’’ প্রচারে বেরিয়েও দেবীপ্রসাদ বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতীকে ভোট দেবেন। আমরা উন্নয়নের পক্ষে ভোট চাইছি। জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের নামে ভোট চাইছি।’’
তবে বিজেপি বলছে, এই আসনে শান্তনুর জন্য বেজায় চাপে তৃণমূল। কারণ, বিজেপি প্রচারে বার বার কারাবন্দি শান্তনুর কথা বলছে। দুর্নীতির কথা বলেই প্রচার করছেন বাপ্পাদিত্য। তিনি বলেন, ‘‘একটা সময় আমি তো তৃণমূল করতাম। শান্তনুর সঙ্গেও কাজ করেছি। কিন্তু যখন দেখলাম দুর্নীতি ছাড়া আর কিছু নেই, তখনই বিজেপিতে গেলাম।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘শুধু সাধারণ মানুষ নয়, যাঁরা ওঁর সঙ্গে মিছিলে হাঁটতেন, ঝান্ডা ধরতেন, তাঁদের থেকেও টাকা নিয়েছে।’’ বাপ্পাদিত্যের দাবি, বলাগড়ের বাসিন্দা হলেও সেখানে গুরুত্ব পেতেন না শান্তনু। তাই তারকেশ্বর, পুড়শুড়া, আরামবাগ এলাকায় এসে সংগঠন দেখতেন। নিজের মতো করে সব চালাতেন।
তবে শুধু শান্তনুর কথা বলে যে ভোট পাওয়া যাবে না, সেটাও বুঝছে বিজেপি। তাই তৃণমূলের সার্বিক কাজকর্মের ত্রুটির অভিযোগ আর বিজেপির অত্যাচারের কথা বলছেন বাপ্পাদিত্য। অন্য দিকে, তৃণমূলের দেবীপ্রসাদের অস্ত্র তৃণমূল সরকারের সাফল্য, মমতার কল্যাণমূলক প্রকল্প। আর এই লড়াইয়ে হুগলি জেলার মধ্যে আলাদা করে নজরে জেলা পরিষদের ৩৬ নম্বর আসনটি।