WB Panchayat Election 2023

লাঠি-ইটে পাঁচশো, বোমায় দৈনিক পাঁচ হাজার বরাদ্দ

গত পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে এ কাজে হাতেখড়ি হয়েছিল রিয়াজের। এ বছর অভিজ্ঞতার নিরিখে আয় বেড়েছে বলে জানায় রিয়াজ। সে জানায়, ডাক পড়লেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

Advertisement
ঋষি চক্রবর্তী
বারাসত শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৩ ০৮:০৮
violence

—প্রতীকী ছবি। Sourced by the ABP

বয়স মেরেকেটে কুড়ি-বাইশ। পড়াশোনার পাট চুকেছে অষ্টম শ্রেণির আগেই। এলাকায় কাজ তেমন নেই। ছোটখাটো কাজ করে নিজের হাতখরচ চালিয়ে নেয় দেগঙ্গার বাসিন্দা রিয়াজ আলি (নাম পরিবর্তিত)। তবে ভোট এলে তার মুখে চাওড়া হাসি ফোটে। এ সময়ে তার হাতে প্রচুর ‘কাজ’। একটি দলের নির্দেশে বিরোধীদের ধমকধামক, হুমকি, প্রয়োজনে মারধরেও সে বেশ পারদর্শী। এ কাজে আয়ও ভাল। দিনে পাঁচশো টাকা বাঁধা। সঙ্গে পেটভরে খানাপিনা।

গত পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে এ কাজে হাতেখড়ি হয়েছিল রিয়াজের। এ বছর অভিজ্ঞতার নিরিখে আয় বেড়েছে বলে জানায় রিয়াজ। সে জানায়, ডাক পড়লেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে থাকে থাকে পাইপ, বাঁশ বা উইকেট। তার কথায়, ‘‘ভোটের সময়ে ভাল রোজগার হয়। ভয় দেখিয়ে ধমক-ধামক দিতে ভালও লাগে। নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হয়। সারা বছর এমন কাজ পেলে মন্দ হত না!’’

Advertisement

জেলার আর এক প্রান্তে অনন্ত দাসের (নাম পরিবর্তিত) অভিজ্ঞতাও একই রকম। সে জানায়, ভোটের আগে এক মাসে হেসেখেলে হাতে ১৫-২০ হাজার টাকা চলে আসে। তার কথায়, ‘‘আমি অত দল বুঝি না। যারা টাকা দেবে, তাদের হয়েই কাজ করব। ছোটবেলায় পাড়ার অনেক দাদা-কাকাদের এ কাজ করতে দেখেছি।’’

শুধু রিয়াজ বা অনন্ত নয়, ওদের মতো এলাকার বহু তরুণ-যুবক এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। বয়স, কুড়ি-পঁচিশের কোঠায়। ভোট এলেই ডাক পড়ে। এ সময়ে ‘কাজের’ জন্য বাইকের তেল, খাওয়াদাওয়া, হাতখরচ সবই বিভিন্ন দল বহন করে। অনন্ত জানায়, ভোটের সময়ে হুমকি, মারামারিতে যারা যোগ দেয়, তাদের বেশিরভাগই টাকার বিনিময়ে এ কাজ করতে আসে। স্বেচ্ছায় দলীয় কর্মী হিসেবে এ কাজ করছেন, এমন সংখ্যা নগন্য।

কাজে ঝুঁকি কেমন? অনন্তের জবাব, ‘‘দলের সমর্থন থাকে আমাদের কাজে। যদি কোনও কারণে ধরা পড়ি, ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে দল। এই অভয়টুকুও দেওয়া হয় দলের তরফে।’’

একটি সূত্রের দাবি, এ কাজে অভিজ্ঞতার ভাল দাম আছে। যারা সদ্য যোগ দেয়, তাদের দৈনিক পারিশ্রমিক শ’পাঁচেক টাকা। অভিজ্ঞদের পারিশ্রমিক দিনে হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। এরা মূলত লাঠি, ইট-পাথর নিয়ে মারামারিতে যোগ দেয়। আবার বোমা, বন্দুক, তির ও ধারাল অস্ত্র নিয়ে যারা হামলা চালায়, তাদের পারিশ্রমিক আরও বেশি। রিয়াজের দাবি, বোমা-গুলি চালানোয় পারদর্শীদের পারিশ্রমিক দৈনিক তিন-পাঁচ হাজার টাকা। উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা যেমন, শাসন বা আমডাঙায় ভাড়াটে সৈনিকদের পারিশ্রমিক দৈনিক ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। যারা তির ও ধারাল অস্ত্রে পারদর্শী, তাদের পারিশ্রমিক এক-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। অস্ত্র হামলায় নতুনদের পারিশ্রমিক গড়ে হাজার টাকা‌। রিয়াজের কথায়, ‘‘বোমা-গুলি চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আগামী ভোটে তা হলে রোজগার আরও বাড়বে।’’ ভোটে ‘লড়তে’ গিয়ে যদি প্রাণ যায়? রিয়াজের উত্তর, ‘‘বাঁচা-মরার কথা কে বলতে পারে!"

বারাসতের বিধায়ক তৃণমূলের চিরঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, "অতীতেও এ সব ছিল, এখনও আছে। বদল হয়নি নির্বাচনে হিংসার চেহারার। জেতার জন্য সকলেই চেষ্টা করছে। পেশিশক্তির ব্যবহার করছে। এ সব বন্ধ করতে যা করার প্রয়োজন ছিল, সে সব করা হচ্ছে না বলেই হচ্ছে।" বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তাপস মিত্র বলেন, "কংগ্রেসকে সরাতে সিপিএম হার্মাদদের দিয়ে বাংলায় অত্যাচার করেছে। তৃণমূল এখন করছে। তৃণমূলও আসলে সিপিএমের পথে হাঁটছে। বেকার যুবকদের টাকার লোভ দেখিয়ে কুপথে আনছে।" সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আহমেদ আলি খানের কথায়, "আমাদের সময়ে যুবকদের ভাড়া নেওয়া হত না। তৃণমূলের কাছে অনেক টাকা। ওরা দুষ্কৃতী পোষে। ভোটে জিততে কাজে লাগাচ্ছে। কর্মক্ষেত্র না থাকলে কী করবে যুব সম্প্রদায়? আমাদের আর কত দোষ দেবেন!’’

কোনও দল ভোটে গুন্ডাবাহিনী ব্যবহারের কথানা মানলেও নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার এক প্রভাবশালী নেতা বলেন, ‘‘চিরকালই ভোটে এ সব হয়ে এসেছে। এই বাহিনীর পিছনে প্রচুর টাকা খরচ করে সকলেই। প্রচার বা ভোটের অন্য কাজের জন্য যা বাজেট, তার থেকে বহু গুণ খরচ। অনেক সময়ে এলাকার ব্যবসায়ী বা ঠিকাদারদের কাছ থেকে এই টাকা তোলা হয়।’’

বারাসত পুলিশ জেলার সুপার বিশ্বচাঁদ ঠাকুর বলেন, ‘‘পুলিশের কাছে এ রকম কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি। যদি কেউ নির্দিষ্ট ভাবে অভিযোগ করেন, তা হলে পুলিশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’’

আরও পড়ুন
Advertisement