গভীর সমুদ্রে অবৈধ ভাবে ব্যবহার করা বেতার তরঙ্গের তল্লাশি। - নিজস্ব চিত্র
মাছের মরসুমে বন্দর ছেড়ে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে কয়েক হাজার ট্রলার। ভারত উপকূলে প্রতিরক্ষা দফতরের কাছে এই ট্রলারগুলি আসলে নজরদার বাহিনী। সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করা বিদেশি জাহাজ থেকে জলপথে পাচার, জলদস্যুদের আনাগোনার খবরও মাছ ধরার ফাঁকে উপকূল রক্ষী বাহিনীকে পাঠিয়ে দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন জীবন বাজি রেখে অতল সাগরে পাড়ি দেওয়া ভারতীয় মৎস্যজীবীরা।
গভীর সমুদ্রে বেশ কিছুটা তফাতে কয়েকটি কমলা বিন্দু দেখিয়ে ভারতীয় উপকূল রক্ষী বাহিনীর সদ্য প্রাক্তন কমান্ড্যান্ট অভিজিৎ দাশগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘ওই বিন্দুগুলি এক একটা ট্রলার। বহু দূর থেকে যাতে সমুদ্র ও আকাশের রঙের মধ্যে মিশে না যেতে পারে, তাই কমলা রং ভারতীয় ট্রলারের। তবে জায়গা বিশেষে তার গঠন আলাদা। এই ট্রলারগুলি যেমন আমাদের নজরদারির প্রথম চোখ, তেমনই এদের মাধ্যমেই খুব সহজে জল সীমান্তে অপরাধ সংগঠিত হতে পারে, অবৈধ রেডিয়ো সেটে খেয়াল খুশি মতো চ্যানেল ব্যবহার করার জন্য।’’
প্রতি বছরই মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলারডুবি হয়ে মৎস্যজীবীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে। কারও কারও হদিশ মেলে না। অথচ, ট্রলারগুলির সঙ্গে মৎস্য বন্দরগুলির যোগাযোগ রাখার জন্য প্রতিটি ট্রলারেই রয়েছে ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) রেডিয়ো সেট। একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলে বন্দরের সঙ্গে বারো থেকে পনেরো নটিক্যাল মাইল থেকে যোগাযোগ করতে পারেন মৎস্যজীবীরা। আবহাওয়ার উপরে নির্ভর করে আরও বেশি দূর থেকেও। সমুদ্রের মধ্যে প্রতিটি ট্রলার পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এই রেডিয়ো সেটের মাধ্যমে। মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে যাওয়া এমনই দু’টি ট্রলারের মৎস্যজীবী জীবন পাত্র এবং সুদেব গায়েন বলেন, ‘‘১৬ নম্বর চ্যানেলে আমরা কথা বলি পরস্পরের সঙ্গে। কোনও কারণে নব ঘুরে গেলে নানা রকম কথাবার্তা শোনা যায়। খেয়াল না করলে তাতেই কথা বলে ফেলি আমরা।’’
উপকূল রক্ষী বাহিনীও ট্রলারগুলির মধ্যে কথোপকথন শুনতে পায় ওই নির্দিষ্ট চ্যানেলে কথা বললে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় যখন চ্যানেল বদল করা হয়। ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠানোর প্রথাগত প্রশিক্ষণ আর বৈধ রেডিয়ো সেট এই দুটোর কোনওটাই নেই অধিকাংশ মৎস্যজীবীর ও ট্রলার বা বন্দরে। এমনকী, মৎস্যজীবীদের ওয়্যারলেস সেট ব্যবহারের জন্য ভারত সরকার ‘ইনল্যান্ড লাইসেন্স’ (রেডিয়ো টেলিফোনিক লাইসেন্স) চালু করলেও তা সে বিষয়ে তাঁদের কোনও ধারণাই নেই বলে জানিয়েছেন মৎস্যজীবীরা। এর ফলে বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ থেকে কলকাতা বন্দরে যাতায়াত করা বার্জগুলির কথোপকথনও শোনা যায় ট্রলারগুলির ভিএইচএফ রেডিয়োয়। অভিজিৎ বলেন, ‘‘প্রায় ১২ হাজার ট্রলার এখন সমুদ্রে যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা, কাকদ্বীপ, ফ্রেজারগঞ্জ থেকে। প্রতিটি ট্রলারেই বিনা লাইসেন্সের এই রেডিয়ো সেট ব্যবহার করা হয়, যা সম্পূর্ণ ভাবে বেআইনি। কিন্তু ধরবে কে?’’
রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিক, যিনি সুন্দরবন পুলিশ জেলার প্রাক্তন কর্তাও, তাঁর কথায়, ‘‘শুধু ভিএইচএফ নয়, সমুদ্রে অনেক দূর পর্যন্ত কথা বলার সুবিধার জন্য কিছু ইউএইচএফ (আল্ট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সি) রেডিয়ো সেটও ট্রলারগুলিতে ব্যবহার করা হয়। রেডিয়ো ও অ্যান্টেনা ব্যবহারের জন্য জাতীয় বেতার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। বিভিন্ন সময়ে অজ্ঞতার কারণেই পুলিশের নির্দিষ্ট রেডিয়ো তরঙ্গেও ঢুকে পড়েন মৎস্যজীবীরা। বিভ্রান্ত হতে হয় সে জন্য।’’
এ দিকে, নামখানা, কাকদ্বীপে ট্রলার মালিকদের বাড়ির ছাদে জিপি, স্লিমজিম, ইয়াগি’র মতো পেশাদার রেডিয়ো অ্যান্টেনা নজরে পড়ে। একই অ্যান্টেনা দেখা যায় ট্রলারগুলিতেও। ব্যবহার করা হয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ব্যবহৃত রেডিয়ো সেটের মডেলগুলি।
কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়্যারলেস প্ল্যানিং অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশন উইং-এর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৎস্যবন্দরগুলি ও ট্রলারে রেডিয়ো ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স নিয়ে মৎস্যজীবীদের সঙ্গে দফতরের সমণ্বয়ের কাজ করছেন গত পাঁচ বছর ধরে। তিনি বলেন, ‘‘আমি ও অন্য বিভাগীয় আধিকারিকেরা বার বার চেষ্টা করেও বৈধ রেডিয়ো তরঙ্গ ব্যবহারে মৎস্যজীবীদের একত্রিত করতে পারিনি। এর অন্যতম অন্তরায়, ট্রলার মালিক এক জন, লিজ় নেন আর এক জন। ট্রলারে শ্রমিকের মতো কাজ করেন মৎস্যজীবীরা। রেডিয়ো ব্যবহারের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। সেটা চেষ্টা করেও ফলপ্রসূ হয়নি।’’ কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতা বিজন মাইতিও স্বীকার করে নেন, ‘‘যোগাযোগের জন্য রেডিয়ো ব্যবহার করলেও তার কোনও লাইসেন্স মৎস্যজীবীদের কাছে নেই।’’
বছর পাঁচেক আগে কাকদ্বীপে মৎস্যজীবীদের নিয়ে সমুদ্রে রেডিয়োয় বার্তা পাঠানোর প্রশিক্ষণের জন্য কর্মশালা করেছিল হ্যাম রেডিয়োর ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাব। তার সম্পাদক অম্বরীষ নাগ বিশ্বাস বলেন, ‘‘অবাধে অবৈধ রেডিয়ো ঢুকছে এ রাজ্যে। কখনও অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে কখনও আবার ডিলারদের কাছ থেকেই মৎস্যজীবীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এই রেডিয়ো। কেনার সময় শুধু দেখে নেওয়া হচ্ছে, কত দূর পর্যন্ত কথা বলা যায়। সেটা নিয়ম মেনে কিনা, তা জানার প্রয়োজন বোধ করেন না ট্রলার মালিকেরা। এতে নজর না দিলে রেডিয়ো তরঙ্গকে ব্যবহার করে সীমান্তে অপরাধ আরও বাড়বে।’’