Trawler Accident

‘বাবা, খাবার আনলে না তো!’

গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে শুক্রবার ট্রলার দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ছিলেন ন’জন মৎস্যজীবী। ট্রলারটি নামখানার কাছে লুথিয়ান দ্বীপে এনে তল্লাশি চালানোর পরে তাঁদের মধ্যে আট জনের নিথর দেহ উদ্ধার হয়েছে রবিবার।

Advertisement
সমরেশ মণ্ডল
কাকদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৯
নিথর দেহ ফিরেছে মৎস্যজীবীদের। ভেঙে পড়েছেন পরিজনেরা। নিজস্ব চিত্র

নিথর দেহ ফিরেছে মৎস্যজীবীদের। ভেঙে পড়েছেন পরিজনেরা। নিজস্ব চিত্র

কালো পলিথিনে মোড়ানো বাবার দেহের দিকে দশ বছরের ছেলে অপলকে তাকিয়ে। কাকদ্বীপ হাসপাতালের মর্গে উপস্থিত মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ, ডাক্তার সকলের দৃষ্টি আবার সদ্য পিতৃহারা ছেলেটির দিকে। বছর তিনেক আগে মা চলে গিয়েছেন নিরুদ্দেশে। রবিবার সে জানতে পারল, বাবাও আর ফিরবে না। স্তব্ধতা ভেঙে ছেলেটির প্রথম কথা, ‘‘বাবা অনেক খাবার আনবে বলেছিলে। কই আনলে না তো?’’ ট্রলার দুর্ঘটনায় মৃত মৎস্যজীবী কানাই দাসের (৪০) ছেলে সুজয়কে জড়িয়ে ধরেন এক চিকিৎসক।

Advertisement

গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে শুক্রবার ট্রলার দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ছিলেন ন’জন মৎস্যজীবী। ট্রলারটি নামখানার কাছে লুথিয়ান দ্বীপে এনে তল্লাশি চালানোর পরে তাঁদের মধ্যে আট জনের নিথর দেহ উদ্ধার হয়েছে রবিবার। নিখোঁজ এখনও এক জন। মৃত কানাইয়ের বাড়ি কাকদ্বীপের কালীনগরে। কানাই প্রতি বার সমুদ্রে গেলে ফেরার অপেক্ষায় দিন গোনেন তাঁর বৃদ্ধা মা ও একমাত্র ছেলে। কানাইয়ে মা প্রতিমা অসুস্থ। ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে নাতিকে নিয়ে এ দিন দুপুরে এসেছিলেন কাকদ্বীপ হাসপাতালে। অচেতন হয়ে পড়েন ফেরার পথে। পথচারীরা চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরান। প্রতিমার আক্ষেপ, ‘‘এ বার খাওয়া-পরার উপায়টুকুও চলে গেল। কী করে মানুষ করব নাতিকে!’’

কালীনগরের জগবন্ধু দাসের (৫৯) তিন ছেলে। স্ত্রী সুচিত্রা বলেন, ‘‘দুই ছেলে রোজগার করে, কিন্তু আমাদের দেখে না। বাধ্য হয়ে অসুস্থ মানুষটা ঝড়-জল উপেক্ষা করে সমুদ্রে যেতেন মাছ ধরতে। নিজের ওষুধটুকুও কিনতে চাইতেন না, পাছে চাল কেনার টাকা কম পড়ে। মাথার উপর থেকে ছাদ সরে গেল মনে হচ্ছে।’’

কাকদ্বীপের কৈলাসনগরের বাসিন্দা বছর চল্লিশের নিখিল দাসেরও মৃতদেহ মিলেছে এ দিন ওই ট্রলারের কেবিনে, মাছ ধরার জাল জড়ানো অবস্থায়। চোদ্দো আর আট বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে নিখিলের স্ত্রী মমতা দিশাহারা। মর্গের বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘পনেরো বছর ধরে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। কত দুর্যোগের কথা শুনেছি ওঁর মুখে। কত সময় সতীর্থদের প্রাণ বাঁচিয়ে নিজেরা ফিরে এসেছেন। এ বার কেন এমন হল!’’ ছেলেদের মৎস্যজীবী হতে দিতে চান না মমতা। বললেন, ‘‘স্বামীও চাইতেন না, ছেলেরা এই বিপজ্জনক পেশায় আসুক। তবে ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার সামর্থ্য আমার নেই।’’

কাকদ্বীপের পশ্চিম গোবিন্দপুর এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন দাসও ট্রলার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। বাড়িতে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী যমুনা। তিনি বলেন, ‘‘কত দুর্যোগ কাটিয়ে ফিরে এসেছে। এ বার কেন পারল না! ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ বলে আর কিছু রইল না।’’

একের পর এক ট্রলার দুর্ঘটনা আর এ বারের প্রাণহানি কার্যত চোখে ফের প্রশ্ন তুলে দিল, গভীর সমুদ্রে মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা বলতে আদৌ কিছু আছে কি!

আরও পড়ুন
Advertisement