নুসরত জাহানের বিভিন্ন পোস্ট। — ইনস্টাগ্রাম
গত ১৬ দিন ধরে সন্দেশখালি জ্বলছে। যে এলাকা বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। যে লোকসভা এলাকার তৃণমূল সাংসদ নুসরত জাহান। কিন্তু সেখানে এক দিনও সাংসদ তথা অভিনেত্রী নুসরতকে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি, তিনি গ্রামে গিয়ে এলাকার সাংসদ হিসেবে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে এই ১৬ দিন ধরে নুসরত ‘সক্রিয়’ থেকেছেন সমাজমাধ্যমে। এক্স (সাবেক টুইটার), ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম— এই তিন মাধ্যমেই রঙিন উপস্থিতি রয়েছে নুসরতের। সেখানে কী ‘সন্দেশ’ দিয়েছেন নুসরত?
তিন মাধ্যমে তাঁর পেজ, হ্যান্ডল দেখে একটা বিষয় স্পষ্ট, নুসরতের জীবনে প্রেম আছে, চুম্বন আছে, যশ দাশগুপ্তকে জড়িয়ে ধরা আছে, অল্পবিস্তর রাজনীতিও আছে—কিন্তু সন্দেশখালি নেই। কোথাও নেই।
এই তিনটি মাধ্যমের মধ্যে ইনস্টাগ্রামে নুসরত সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। গত ১৬ দিনে সেখানে নানাবিধ পোস্ট করেছেন তিনি। বস্তুত, এই দফায় সন্দেশখালিতে উত্তেজনা শুরু হয়েছিল ৮ ফেব্রুয়ারি। সে দিন শাহজাহানের বাহিনীর বাইক মিছিল ‘রুখে’ দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গণরোষ এমন আকার নিয়েছিল যে, গ্রাম ছেড়ে পালাতে হয় শাহজাহান বাহিনীকে। কাউকে কাউকে দেখা যায় লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিতে। ওই দিন সংসদে ছিলেন নুসরত। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় দাবি করেছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার যেন বাংলার বকেয়া অর্থ মিটিয়ে দেয়। সেই বক্তৃতা এক্সে পোস্ট করেছিলেন বসিরহাটের তৃণমূল সাংসদ। কিন্তু ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে তাঁর পোস্ট ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ফেসবুকে ‘প্রোপোজ় ডে’ উপলক্ষে একটি পোস্টার পোস্ট করেছিলেন অভিনেত্রী। আর ইনস্টাগ্রামে তাঁর পোস্টে জায়গা পেয়েছিল তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী যশ দাশগপ্তের নতুন ছবি ‘সেন্টিমেন্টাল’-এর একটি গানের তিন মিলিয়ন (৩০ লক্ষ) ‘ভিউ’ হওয়ার উদ্যাপন।
তার পর থেকে সন্দেশখালি এক দিনের জন্যও শান্ত হয়নি। বরং প্রতি দিন নতুন ভাবে তপ্ত হয়েছে। প্রকাশ্যে এসেছে মহিলাদের উপর ধারাবাহিক নির্যাতনের অভিযোগও। যদিও সেই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে শাসক ও বিরোধী শিবিরের দাবি-পাল্টা দাবি রয়েছে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইনস্টাগ্রামে জোড়া পোস্ট করেছেন নুসরত। তার একটিতে নতুন ছবিতে যশের সংলাপের ভিডিয়ো। যে সংলাপে পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করা যশকে বলতে শোনা যাচ্ছে (সমাজবিরোধীদের মারতে মারতে), ‘‘তোরা গুন্ডা হলে আমি সরকারি গুন্ডা। মারলে হিরো, মরলে মেডেল।’’ পাশাপাশিই একটি গানের রিল পোস্ট করেছিলেন সাংসদ। ফেসবুকেও যশের সংলাপের ভিডিয়ো পোস্ট করা রয়েছে। রয়েছে ‘চকোলেট ডে’ উদ্যাপনের পোস্টারও। সে দিন এক্সে কোনও পোস্ট করেননি নুসরত। ঘটনাচক্রে, যে দিন নুসরত এই সব পোস্ট করছেন, সে দিনই ‘তৃণমূলের সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে সন্দেশখালির পরিস্থিতি নিয়ে পার্থ ভৌমিক, সুজিত বসু, নারায়ণ গোস্বামীদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ইনস্টাগ্রামে তিনটি পোস্ট করেছিলেন নুসরত। একটি ছবির ‘ব্র্যান্ডিং’ নিয়ে। দ্বিতীয়টি যশের সঙ্গে একটি আড্ডার ক্লিপিং এবং তৃতীয়টি ‘টেডি ডে’-র পোস্টার। ফেসবুক এবং এক্সেও ‘টেডি ডে’-র পোস্টার পোস্ট করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ। সে দিনও সন্দেশখালি উত্তপ্ত। প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল সে দিন।
১১ ফেব্রুয়ারি কোথাও নুসরতের কোনও পোস্ট দেখা যায়নি। ১২ ফেব্রুয়ারি শুধু ফেসবুকে ‘হাগ ডে’-র পোস্টার পোস্ট করেছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে নুসরতকে জড়িয়ে রয়েছেন যশ। ১৩ ফেব্রুয়ারি ফের নুসরতকে দেখা যায় ইনস্টাগ্রামে। সে দিন বেশ কয়েকটি নিজের ছবি পোস্ট করেছিলেন সাংসদ। তাঁর পরনে সাদা চিকনের কাজ করা সালোয়ার। গায়ে জড়ানো জমকালো সুতোর কাজের স্টোল। আবহে বাজছে মিঠে বাঁশির সুর। সঙ্গে হালকা ড্রামবিট্স। সে দিন নুসরতের পেশাগত বন্ধু তথা তৃণমূল সাংসদ মিমি চক্রবর্তী সংসদের একাধিক কমিটি থেকে ইস্তফা দেন। আর সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে মিছিল, অবরোধ, বিক্ষোভে উত্তাল হয় কলকাতা।
১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল সরস্বতী পুজো এবং ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। ওই দিন নুসরতের ইনস্টাগ্রাম প্রেমে ডগমগ। গঙ্গাবক্ষে একটি বার্জে দেখা যায় যশ-নুসরতের নানা ধরনের ছবি। ফেসবুকে অবশ্য মাত্র একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন সাংসদ। সঙ্গে ইংরেজি ক্যাপশন— ‘তুমি কি আমার ভ্যালেন্টাইন হবে?’ সে দিন বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কর্মসূচি ঘিরে তোলপাড় হয়েছিল বসিরহাট। অসুস্থ সুকান্তকে কলকাতার হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয়েছিল।
ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকে ১৫ এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘সেন্টিমেন্টাল’-এর প্রচার করেছেন বসিরহাটের সাংসদ নুসরত। ১৭ ফেব্রুয়ারি আশমানি নীল রঙের লং ড্রেসে বেশ কয়েকটি ছবি পোস্ট করেন ইনস্টাগ্রামে। সে দিনও সন্দেশখালি তপ্তই ছিল। সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন রাজ্যপুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। তার পরেই গ্রেফতার হন সন্দেশখালিতে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা শিবু হাজরা। ১৮ ফেব্রুয়ারি নুসরত কোথাও কোনও পোস্ট করেননি।
১৯ ফেব্রুয়ারি নুসরতকে দু’টি মাধ্যমে দু’টি ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। ইনস্টাগ্রামে ঝকমকে পোশাক পরে একটি রিল পোস্ট করেছিলেন। সেই পোশাকে রয়েছে কড়ি, কাচ। পাশাপাশি ঠাসা সুতোর কাজ। ঘটনাচক্রে, সে দিনই অনেকের আধার কার্ড বাতিল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেটি এক্সে পোস্ট করেছিলেন মমতা। নুসরত মমতার সেই চিঠিটি রিপোস্ট করেন। ২০ ফেব্রুয়ারিও ওই পোশাকেই বেশ কিছু ছবি ইনস্টাগ্রামে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী-সাংসদ। সে দিন সন্দেশখালি আরও উত্তাল। বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী, সিপিএমের বৃন্দা কারাটেরা সেখানে গিয়েছিলেন। সে দিনই শুরু ‘খলিস্তানি’ বিতর্ক। সে সব নিয়েও বসিরহাটের সাংসদ সমাজমাধ্যমে নীরবই থেকেছেন। তবে ২১ ফেব্রুয়ারি এক্সে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পোস্ট করেছেন নুসরত। ২২ তারিখ একটি পার্টিতে কালো পোশাকে নানা বিভঙ্গের ছবি দিয়েছেন ইনস্টাগ্রামে। শুক্রবারও তাঁর পোস্টে জায়গা পেয়েছে ‘সেন্টিমেন্টাল’।
এই ১৬ দিনে সন্দেশখালি নিয়ে কোনও সন্দেশ সমাজমাধ্যমে দেননি নুসরত। তবে তাঁর বিবিধ পোস্ট দেখে তৃণমূলের অন্দরে অনেকেই কৌতূহলী— নুসরত কি লোকসভা ভোটে টিকিট না পাওয়ার ‘সন্দেশ’ পেয়ে গিয়েছেন? নইলে তিনি সন্দেশখালি নিয়ে এত নিস্পৃহ কেন?