মেরু ভল্লুকের সন্ধানে

‘একমাত্র ক্রেগই সমুদ্রের জল ঢুকে যাওয়া এয়ারস্ট্রিপে প্লেন ল্যান্ড করাতে পারে।’ বলেছিল লরেন্ট। তাই তলব পড়ল ক্রেগ-এর। আলাস্কার ব্রুকস রেঞ্জে কালো মেঘের উপর দিয়ে বার্টার আইল্যান্ডে আট জনের চার্টার্ড বিমান দুলতে দুলতে কোনও মতে পৌঁছল। যেখানে অপেক্ষা করেছিল ভয়াবহ সেই মুহূর্ত! বিমানবন্দরে সমুদ্রের জল ঢুকে যাওয়ায় উপর থেকে দেখা যাচ্ছে শুধু জল আর জল। অতিরিক্ত বৃষ্টি আর বরফ পড়ায় সুমেরু সাগরের জল ঢুকে গিয়েছে এয়ারস্ট্রিপে। তবে ভয় নেই। এ তো ক্রেগ-এর বিমান! লিখছেন সুচেতনা মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী।

Advertisement
সুচেতনা মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী
আলাস্কা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
ঝঞ্ঝাপ্রবণ সুমেরু সাগর...

ঝঞ্ঝাপ্রবণ সুমেরু সাগর...

‘একমাত্র ক্রেগই সমুদ্রের জল ঢুকে যাওয়া এয়ারস্ট্রিপে প্লেন ল্যান্ড করাতে পারে।’ বলেছিল লরেন্ট। তাই তলব পড়ল ক্রেগ-এর। আলাস্কার ব্রুকস রেঞ্জে কালো মেঘের উপর দিয়ে বার্টার আইল্যান্ডে আট জনের চার্টার্ড বিমান দুলতে দুলতে কোনও মতে পৌঁছল। যেখানে অপেক্ষা করেছিল ভয়াবহ সেই মুহূর্ত!

বিমানবন্দরে সমুদ্রের জল ঢুকে যাওয়ায় উপর থেকে দেখা যাচ্ছে শুধু জল আর জল। অতিরিক্ত বৃষ্টি আর বরফ পড়ায় সুমেরু সাগরের জল ঢুকে গিয়েছে এয়ারস্ট্রিপে। তবে ভয় নেই। এ তো ক্রেগ-এর বিমান!

Advertisement

এস্কিমো রব থমসন দাঁড়িয়েছিলেন ছ’জন আরোহীর জন্য। আমেরিকান, অস্ট্রেলীয়, ব্রিটিশ-লরেন্ট, ফ্রেডদের সঙ্গে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেশের প্রতিনিধি নির্মাল্য চক্রবর্তী— যাঁরা অভিযান করবেন উত্তর মেরুর কাছে। অল্প কিছু পোলার বিয়ার-এর অস্তিত্ব সেখানে আজও বজায় আছে। জীববিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, ডাইনোসরের মতোই আগামী পঞ্চাশ বছরের ভিতর বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে আলাস্কান পোলার বিয়ার।


মরু ভল্লুক...

তিন দিন আগে যখন তাঁরা পথ চলা শুরু করেছিলেন, তখনও জেমস ডাল্টন হাইওয়ের আকাশে ছিল রাশিকৃত কালো মেঘ। পৃথিবীটা যে সাদাকালো মুভির ক্লিপিংস! এই প্রথম দেখা কোনও মেঠো পথের হাইওয়ে ধরে গাড়ির চাকা দু’পাশের ধুলো উড়িয়ে নিয়ে চলেছে প্রোডু বে— সুমেরু সাগরের ধারে।

ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে ইউকন নদীর কিছু পরে, পথেই পার হল সুমেরু বৃত্ত (আর্ক্টিক সার্কল)। সেই ছেলেবেলায় ভূগোল বইতে সীমাবদ্ধ থাকা ‘সুমেরু বৃত্ত’ ছুঁতে পেরে কেমন লাগছিল? অভিযানকারী দলের সদস্য নির্মাল্যের উত্তর, “এ যেন এক অবাক পৃথিবী। ভয়ঙ্কর সুন্দর। ভয়টাকে অতিক্রম করে এমন সৌন্দর্য উপভোগ করার মজাই আলাদা।” সুমেরু বৃত্তের কিছু পরেই ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি আর বরফ যেন ঘিরে ধরল তাঁদের।


অভিযাত্রী...

হাইওয়ের পাশে পাশে চলেছে একটি গ্যাসের পাইপলাইন। স্যাটেলাইট থেকেও এই পাইপ স্পষ্ট দেখা যায়। আলাস্কাকে ভাগ করেছে বলে একে ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অফ আমেরিকা’ও বলে। ১৯৬৮-তে সুমেরু সাগরে তেল আবিষ্কারের পর ৮০০ মাইল জুড়ে এই পাইপলাইন বসানো হয়। বিপরীত দিক থেকে মাঝে মাঝে অয়েল ট্রাকগুলি বিপজ্জনক ভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। পাহাড়ে এই চড়াই তো ফের উতরাই। কাদামাটিতে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া রাস্তায় গাড়ি স্কিড করতে করতে শেষে পৌঁছল এটিগন পাস। এখান থেকে যে দিকে চোখ যায় শুধু সাদা আর সাদা। ঘণ্টায় প্রায় ৫৩ মাইল বেগে হিমেল হাওয়া আর তুষারপাত। রাস্তার বরফ কেটে গাড়ির এগিয়ে চলা যখন প্রায় অসম্ভব, কোনও মতে থেমে থেমে এগোতে থাকল নির্মাল্যদের আট-সিটারের বড় গাড়ি।

সূর্য চলে গিয়েছে মেঘের আড়ালে। মোটা বরফের আস্তরণে ধস নামতে পারে, চার দিকে সেই সতর্কবার্তা নিয়ে ‘ֹডেঞ্জার’ সাইনবোর্ড। দু’চারটে ট্রাক অচল হয়ে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে। টুনড্রা পৌঁছে সরু লিকলিকে হাইওয়ের দু’ধারে ধূ-ধূ করছে শূন্যতা। অবশেষে বরফের চাদর সরিয়ে দূরে স্পষ্ট হল মহানগর। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি আর তুষারঝড়ে নাজেহাল অভিযাত্রীরা এক ভয়ঙ্কর আবহাওয়ার মুখোমুখি। তবে মহানগরে পৌঁছে একেবারে আটকে পড়লেন তাঁরা। মরুদ্যানের মতো একটিমাত্র হোটেল, সেখানেই সবাই ঘরবন্দি। ও দিকে বার্টার আইল্যান্ডেও বাণিজ্যিক বিমানগুলি সব বাতিল। তাই সকলেই নিরুপায়।


ঝঞ্ঝাময় ব্লিজার্ড...

তবে শেষমেশ সেই বার্টার আইল্যান্ডের জলভরা এয়ারস্ট্র্যাপেই নামতে হয়েছিল। সফল হয়েছিলেন পাইলট ক্রেগ।

এস্কিমো রবের বাড়িতে থাকার সুযোগ হয়। “দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।” বলেছিলেন নির্মাল্য। আর্ক্টিক ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ রেফিউজ পার্ক সার্ভিসের আনাচ কানাচ রবের নখদর্পণে। তার সঙ্গেই তিন দিন ধরে চলল মহাসমুদ্রে অভিযান।

ছোট মোটরবোটে জনা আটেক মানুষ মাথায় একরাশ বরফ, প্রবল বেগে এলোমেলো হাওয়া আর ঢেউয়ে উথালপাথাল হয়ে উত্তর মেরুর কয়েকশো মাইল দূরেই খোঁজ পেলেন তাদের। ছোট্ট একটা দ্বীপ, যেন পোলার বিয়ারের দেশ। সঙ্গে স্নোয়ি আউল আর একঝাঁক সাদা স্নো গিজ ও ক্যারিবু মাস্কঅস্ক। নির্মাল্যর কথায়: “পৃথিবীর উষ্ণায়ণে জেরবার এই প্রাণীদের জীবনযাত্রার বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। বরফ ধীরে ধীরে গলে যাওয়ায় পোলার বিয়ারের প্রধান খাদ্য সিল মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। অন্যত্র চলে যাচ্ছে তিমি মাছের দল। একটি মা পোলার বিয়ার ও তার দুই সন্তানের সঙ্গেও কিছু সময় আমরা কাটিয়েছি। তাদের জীবনযাত্রার গোপনীয়তার বেশ কিছু মুহূর্ত ফিল্মিং-এর মাধ্যমে ধরে রাখা হয়েছে।”

ছবি: নির্মাল্য চক্রবর্তী।

বাংলাসাহিত্যে স্নাতকোত্তর৷ একটি প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রে কিছু দিন কর্মরত ছিলেন৷ বর্তমানে নিউইয়র্কের বাসিন্দা৷ জঙ্গল প্রেমীদের জন্য একটি বই লিখেছেন৷ ভারতের পাঁচটা জঙ্গল নিয়ে গবেষণা করে লেখা এই বইটি ২০১১ সালে কলকাতা বইমেলাতে প্রকাশিত হয়৷ জঙ্গলের আদিবাসীদের নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেন৷

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement