এ বঙ্গে ভূতের ভবিষ্যৎ সত্যিই উজ্জ্বল।
শ্ শ্ শ্...খুব শিগগিরি এখানে হানাবাড়ি বা ভূত-বাংলো পর্যটন শুরু হতে চলেছে যে!
ইংরেজি প্রবাদে বলে, ডেড মেন টেল নো টেলস। অশরীরীরা গল্প বলে না। কিন্তু অশরীরীদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গা শিরশির করা, হাড় হিম করা আষাঢ়ে সব গল্প। এই সব গল্পের দালানকোঠা এ বার পর্যটকদের জন্য খুলে দিতে চলেছে রাজ্য পর্যটন দফতর।
ভাঙাচোরা কাঠের দরজা। মাকড়সার জালে ঢাকা। শ্যাওলা ধরা ইটের পাঁজা এখানে-ওখানে। ভিতরে ঢুকতেই ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল দু’টো বাদুড়। অভ্যর্থনা জানাতে সামনে দাঁড়িয়ে একটি কঙ্কাল। আচমকা তীক্ষ্ন শব্দে পিলে চমকানোর জোগাড়...।
আজকাল বিভিন্ন মল, সায়েন্স মিউজিয়াম বা বিনোদন পার্কে মজুত থাকে এই ধরনের হানাবাড়ি বা ‘স্কেয়ারি হাউস’। কৃত্রিম ব্যবস্থাপনায় তৈরি গা ছমছমে বা ভুতুড়ে অনুভূতি। পয়সা দিয়ে কিছু ক্ষণের জন্য আতঙ্ক কেনার আয়োজন।
কিন্তু এ বার আর অমন সংক্ষিপ্ত বিনোদন নয়। বাছাই করা ১০টি হানাবাড়িকে ঘিরে পুরোদস্তুর পর্যটন প্রকল্প তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য পর্যটন দফতর। প্রথাগত ভ্রমণের বাইরে এই বিশেষ পর্যটনের জন্য যে মেজাজ ও আবহের প্রয়োজন, তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’।
গত সপ্তাহে রাজ্যের সব জেলাশাসককে চিঠি দিয়ে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এই ধরনের হানাবাড়ির তালিকা ও বিস্তারিত বিবরণ পাঠাতে বলা হয়েছে। তার মধ্যে থেকেই বেছে নেওয়া হবে ১০টি পোড়োবাড়ি। প্রথম দফায় চারটি বাড়িকে ঘিরে শুরু হবে পর্যটন। এর জন্য প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছে দু’কোটি টাকা।
পর্যটন দফতর সূত্রের খবর ঐতিহাসিক তাৎপর্য, ঐতিহ্য, কাছাকাছির মধ্যে রিসর্ট ও পার্কিং লট-এর প্রয়োজনীয় জায়গা আছে কি না, সে সব বিচার করেই হানাবাড়িগুলিকে বেছে নেওয়া হবে। কাছের ফাঁকা জমিতে তৈরি হবে বিলাসবহুল কটেজ, যেখানে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত থাকবে। আর সূর্যাস্তের পর কালো জোব্বা পরা কোনও ব্যক্তি বা মহিলা মোমবাতি হাতে পর্যটকদের ওই হানাবাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবেন। গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্প শোনাবেন। জোগান দেবেন ইতিহাসের জরুরি তথ্য।
গা শিরশিরানি ভাব যাতে আরও জাঁকিয়ে বসে, সে জন্য শব্দ ও আলোর খেলায় তৈরি হবে উপযুক্ত পরিবেশ। কোনও রাতে পর্যটকেরা হয়তো শুনতে পাবেন, পোড়ো বাড়ি থেকে ভেসে আসা মেহের আলির কণ্ঠস্বর, “তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়!” কখনও শোনা যাবে ওয়াল্টার ডে লা মেয়ার-এর অমর কবিতা ‘দ্য লিসনার্স’-এর আবৃত্তি। পর্যটন দফতরের আশা, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ বিদেশি পর্যটকদের কাছেও সমাদর পাবে।
মডেলটা তো আসলে বিদেশেরই। আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো দেশে ভুতুড়ে বাড়ি ঘিরে পর্যটন খুবই প্রচলিত। এ ব্যাপারে সব চেয়ে এগিয়ে সম্ভবত স্কটল্যান্ড। স্কটিশ রাজধানী এডিনবরায় ভুতুড়ে পর্যটনকেন্দ্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মেরি কিঙ্গ-এর বাড়ির গুপ্তকক্ষকে এডিনবরার সবচেয়ে ভুতুড়ে স্থান বলা হয়। ১৬৪৫-এ বহু প্লেগরোগীকে ওই ঘরে বন্দি করে দেওয়ালে গাঁথনি তুলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে মহামারী না ছড়ায়। ওই রোগীদের আত্মা নাকি সেখানে এখনও ঘুরে বেড়ায়।
ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’র স্মৃতি জড়িয়ে আছে স্কটল্যান্ডের স্লাইনস বে এবং রোমানিয়ার ব্রান কাস্ল-এর সঙ্গে। দু’টি জায়গাতেই পর্যটকদের ভিড়। আবার অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত স্লাইনস দুর্গের কাছে ‘কিলমারনক আর্মস’ নামে যে হোটেলটিতে স্টোকার প্রায়ই থাকতেন, সেটাও ভ্রমণার্থীদের কাছে আলাদা আকর্ষণ। এডিনবরা দুর্গ, রোসলিন চ্যাপেল, ফাইভি দুর্গের মতো জায়গাও ভুতুড়ে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত।
খাস লন্ডনেও ভৌতিক পর্যটনকেন্দ্রের সংখ্যা ডজন খানেক। যার মধ্যে অন্যতম ৫০ বার্কলে স্কোয়ার, যেখানে পুরনো বই বিক্রেতা সংস্থা, ম্যাগ্স ব্রাদার্স-এর দফতর। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েল্স-এর মন্টি ক্রিস্টো ম্যানসনকে বলা হয় সে দেশের সব চেয়ে ভুতুড়ে জায়গা। সে জন্য পর্যটকের ভিড়ও সেখানে বেশি।
ভারতেও নানা পুরনো ভবন ও কেল্লার সঙ্গে নানা আখ্যান জড়িয়ে আছে। তার মধ্যে পয়লা নম্বরে রাজস্থানের ভানগড় দুর্গ। সূর্যাস্তের পর ও সূর্যোদয়ের আগে সেখানে পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। অন্ধকারে ভানগড়ে ঢুকলে নাকি আর ফিরে আসা যায় না। কেন? মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের ভাই মাধোসিংহ ভানগড়ের রাজা ছিলেন সপ্তদশ শতকে। কারও মতে, তাঁর গুরু বালু নাথের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রাসাদের উচ্চতা অনেকটা বাড়ানো হয়েছিল। তাই গুরুর অভিশাপে শ্মশান হয়ে যায় ভানগড়। আবার অন্য একটি লোকগাথা অনুযায়ী, সিংঘিয়া নামে এক তান্ত্রিক রাজকুমারী রত্নাবতীকে বিয়ে করতে না পেরে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল। সিংঘিয়ার মৃত্যুর বছর খানেক পরেই আজবগড়ের সঙ্গে যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায় ভানগড়।
কালিম্পঙে পর্যটন দফতরের লজ ‘মর্গান হাউস’-এরও ভুতুড়ে বাড়ি হিসেবে নামডাক আছে। প্রত্যেক কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে মিসেস মরগ্যানের আত্মা নাকি লজে ঢুকে দেখেন, অতিথিদের সেবাযত্ন ঠিকঠাক হচ্ছে কি না।
কিন্তু এ সবই হল উপরি পাওনা। কোনও দুর্গ বা লজ দেখতে গিয়ে তার সঙ্গে ভূতের গল্প শুনতে পাওয়া। কিন্তু ভৌতিক কিংবদন্তিকেই তুরুপের তাস করে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটানোর যে পরিকল্পনা রাজ্য নিয়েছে, সেটা এ দেশে আগে হয়নি। পর্যটন দফতর বলছে, মূলত ব্রিটিশ মডেল অনুসরণ করেই এগোচ্ছেন তাঁরা। প্রাথমিক ভাবে মুশির্দাবাদে মিরজাফরের প্রাসাদ, নদিয়ার করিমপুরের নীলকুঠি কিংবা কলকাতার লর্ড ক্লাইভের বাড়ির কথা তাঁদের মাথায় রয়েছে। পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলছেন, “আমরা কোনও ভাবেই ভূতপ্রেত-কুসংস্কারকে উৎসাহ দিচ্ছি না। ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরাই সরকারের লক্ষ্য। কিন্তু সেটা যদি গা ছমছমে পরিবেশে হয়, তা হলে অনেকে মনে মনে সেই পুরনো সময়ে ফিরে যেতে পারবেন।” ভবিষ্যতে এই প্রকল্প থেকে মোটা আয়ের সম্ভাবনা দেখছে পর্যটন দফতর। এটা হেরিটেজ পর্যটনেরই একটা অঙ্গ।
ভাবনাটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্তও। তিনিও বলেন, “ব্রিটেন, আমেরিকায় এই রকম পর্যটন বহু বছর চালু আছে। এর দৌলতে ওই বাড়িগুলোরও সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ হবে। যেটা খুবই ভাল উদ্যোগ।”
কিন্তু ভুতুড়ে পরিবেশে ভয় পেয়ে পর্যটকেরা দূরে সরে থাকবেন না তো? “ঠিক তার উল্টোটা। এই ধরনের হাড় হিম করা অভিজ্ঞতাই অনেকে পেতে চান। এই আয়োজন তাঁদেরই জন্য,” আত্মবিশ্বাসী ব্রাত্যবাবু।
কথাটা তো সত্যিই। বুদ্ধদেব বসু সেই কবেই বলেছিলেন, “ভূত আমাদের অন্তরের একটা অনুভূতি। আমরাই তাকে সৃষ্টি করেছি মনের ইচ্ছা থেকে। ভূত আমরা চাই।”