জ্যাভলিনে সোনাজয়ী নীরজ চোপড়া। শনিবার টোকিয়োয়। গেটি ইমেজেস
মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। অলিম্পিক্স অ্যাথলেটিক্সে পদক, তা-ও আবার সোনা! সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না। ক’জন আর ভাবতে পেরেছিলেন, টোকিয়োয় আমাদের শেষটা এ ভাবে হবে— নীরজ চোপড়া, একটা বাচ্চা ছেলে, গলায় সোনার পদক ঝুলিয়ে বিজয়মঞ্চে দাঁড়াবে, আর ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজবে!
অ্যাথলেটিক্সে অন্তত একটা পদকের স্বপ্ন তো বহু-বহু যুগ ধরেই আমরা দেখে আসছিলাম। একটা সময় বোধহয় সেই স্বপ্নের কথা ভুলেও গেলাম। অনন্ত কালেও অপেক্ষা যদি শেষ না হয়, তা হলে তো এ রকমই হবে! তার উপরে আমি নিজে একেবারে আক্ষরিক অর্থে ভুক্তভোগী। এক বার তো আমারই মুঠো থেকে ছিটকে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল সেই স্বপ্নটা।
হ্যাঁ, চুরাশির লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক্সের কথা বলছি। তার আগে মস্কোতেও গিয়েছি অ্যাথলটিক্স থেকে পদক আনতে। কিন্তু রাশিয়ায় পারিনি। চার বছর পরে যুক্তরাষ্ট্রেও পারলাম না। এ বার মেয়েদের চারশো মিটার হার্ডলসে ব্রোঞ্জের থেকে আমি সেকেন্ডের ভগ্নাংশে পিছিয়ে থাকলাম। সেই আফসোস শেষ ৩৫ বছর ধরে মনের ভিতরে ঝড় তুলেছে। যত বার ভাবতে বসেছি, বিশ্বাস করুন তত বার কান্না পেয়েছে।
শুধু তো আমি না! আমার অনেক আগে ‘উড়ন্ত শিখ’ মিলখা সিংহও প্রায় স্বপ্নের তীরে পৌঁছে শেষরক্ষা করতে পারেননি। তাই মিলখাজির কষ্টটা অনুভব করতাম। উনিও আমার মতোই রোম অলিম্পিক্সে ০.১ সেকেন্ডের জন্য চতুর্থ হয়ে যান। সে বার ৪০০ মিটারে ব্রোঞ্জজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার স্প্রিন্টার সময় নিয়েছিলেন ৪৫.৫ সেকেন্ড। মিলখা সেখানে দৌড়ন ৪৫.৬ সেকেন্ডে। ভাবুন, এ রকম ঘটলে এক জন অ্যাথলিটের মনের অবস্থাটা কী হয়!
কে না জানে, সব খেলার জননী হচ্ছে অ্যাথলেটিক্স। সেখানে একটা পদক যে কতটা মহার্ঘ্য, তা বলে বোঝানো যায় না। আমি তো তবু দেখতে পেলাম হরিয়ানার তরুণ তুর্কি অ্যাথলিটের অতুলনীয় জ্যাভলিন ছোড়া। কিন্তু খারাপ লাগছে, মিলখাজি দেখতে পেলেন না বলে। তিনি তো কবে থেকেই এই মুহূর্তটার জন্য দিন গুনেছেন। আন্দাজ করতে পারছি, আজ উনি বেঁচে থাকলে ঠিক কতটা খুশি হতেন। দূর্ভাগ্য ইতিহাস সৃষ্টির মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি চলে গেলেন।
সবাই জানে কেরলে আমরা অলিম্পিক্সের ট্র্যাক ইভেন্ট দেখার জন্যই উন্মুখ হয়ে থাকি। আমাদের এখানে এই ইভেন্ট অসম্ভব জনপ্রিয় বলে। তাই অলিম্পিক্স অ্যাথলেটিক্সে স্বপ্নের সোনার জন্য আমাদের আকুতিটা বোধহয় চিরকালই একটু বেশি। তাই খোঁজখবরও রাখার চেষ্টা করি সবসময়। টোকিয়োয় রওনা হওয়ার আগে থেকেই আমাদের মনে নীরজকে নিয়ে বিরাট আশা ছিল। মনে হয়েছিল, ছেলেটা পারলেও পারতে পারে। তাই শনিবার আমরা সবাই মিলে দল বেঁধে ওর জ্যাভলিন ছোড়া দেখতে বসেছিলাম। তার আগে যোগ্যতা অর্জনের লড়াইটাও একই ভাবে দেখেছি। যেখানে মাত্র একটা ছোড়াতেই ও সেরা হয়ে গেল। সেটাও কম বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল না।
জানতাম নীরজের সোনা জেতার ক্ষমতা আছে। কিন্তু ভয়টা ছিল জার্মানির ইয়োহানেস ফেইটাকে নিয়ে। ও যে বিশ্বের অন্যতম সেরা! কিন্তু প্রায় নিয়ম করে ফাইনালে আমাদের ছেলেটা ৮৫ মিটারের উপরে ছুড়ে গেল। যা সত্যি ভাবা যায় না। মুগ্ধ করল ওর ধারাবাহিকতাও। ফাইনালেও নীরজের আত্মবিশ্বাস উপচে পড়ছিল। এই আত্মবিশ্বাসটা ধরা যায় একজন অ্যাথলিটের হাঁটাচলা সবকিছুর মধ্যেও। আমি নিজে তো সেটা দিব্যি বুঝতে পারি। নীরজকে দেখে যেটা বারবারই মনে হচ্ছিল।
আমি কিন্তু নীরজকে চিনি পোলান্ডে ও বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতার সময় থেকেই। কতই বা বয়স তখন! আমি ওখানে গিয়েছিলাম কয়েক জন স্প্রিন্টারের কোচ হয়ে। তখন থেকেই লক্ষ্য করতাম, ছেলেটা নিজের ইভেন্টে কতটা মনঃসংযোগ করে! অন্য আর কিছুতেই যেন আগ্রহ নেই। আরও দেখতাম, বাজে সময় নষ্ট করাটা ছেলেটার ধাতেই নেই। ঠিকঠাক অনুশীলন করে। যেটুকু বিশ্রাম নেওয়ার দরকার, নিচ্ছে। কোচদের সঙ্গে আলোচনা করছে। অন্য অ্যাথলিটদের সঙ্গে কথা বলেও যেন অনেক কিছু শিখতে চাইছে। বেশির ভাগ সময়টাই দেখতাম, জ্যাভলিন নিয়ে পড়ে আছে। তার জন্য একের পর এক ভিডিয়ো পর্যন্ত দেখে যাচ্ছে।
নীরজ এমনিতে কিন্তু একেবারে সহজ-সরল ছেলে। যে কেউ ইচ্ছে করলে ওর সঙ্গে কথা বলতে পারে। সঙ্গে বড়দের সম্মান দিতেও জানে। মুখে সবসময় হাসি লেগে আছে। দেখলেই যে কারও ভাল লাগবে। কমবয়সিরা তো এ রকমই হবে! এমনিতে নীরজের উঠে আসার অনেক কারণ আছে। তার একটা অবশ্যই বড় বড় প্রতিযোগিতায় নামতে পারার সুযোগ পাওয়াটা। তার উপরে ইউরোপেও প্রস্তুতি নিয়েছে। ওর কয়েক জন কোচ তো জার্মানির! যারা আবার একসময়ের জ্যাভলিনের বড় বড় তারকা। আমি বলব ওর এই সোনা জেতাটা বেশি কৃতিত্বের কারণ নীরজ সদ্য চোট সারিয়ে উঠেছে। এই ছেলেটা যে সত্যি সত্যিই স্বপ্ন সত্যি করল। এখনও যা বিশ্বাস হচ্ছে না। (টিসিএম)