শ্বেতার অনেক স্বপ্নই থমকে।
রক্তেই কুস্তি ছিল। বাবা নন, দাদু মাতাফের দুবে এক সময় কুস্তি লড়তেন। রক্তের সেই উত্তরাধিকার নিয়েই একদিন বাবার হাত ধরে উত্তর কলকাতার জোড়াবাগানের পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতিতে গিয়েছিলেন শ্বেতা। তারপর কুস্তিকে ভালবাসা। একের পর এক মাইলফলক টপকে এখন ভারতের জাতীয় মহিলা কুস্তি দলের সদস্য বাংলার শ্বেতা দুবে। ২০১৭ থেকে ২০১৯— টানা তিন বার রাজ্য চ্যাম্পিয়ন শ্বেতার মনে নতুন করে স্বপ্ন জেগে উঠেছে টোকিয়ো অলিম্পিক্সে কুস্তিতে ভারতের পদকপ্রাপ্তির পরে। কিন্তু বড় কিছু ভাবার আগেই বাংলার ‘দঙ্গল-কন্যা’ ভাবছেন, একটা চাকরি পাওয়া খুবই দরকার। কুস্তি চালিয়ে যেতে গেলে যে অনেক টাকা প্রয়োজন। বড্ড খিদে পায় কুস্তিতে। জানালেন শ্বেতা।
আদতে কলকাতার শ্যামবাজার এলাকার মেয়ে হলেও এখন শ্বেতা থাকেন হুগলির ডানকুনিতে। কিন্তু ছেলেবেলার সেই আখড়া ছাড়েননি। এখনও পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতির মাটি গায়ে মেখেই কুস্তি চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য এই আখড়ার ইতিহাসও কম পুরনো নয়। জাতীয় স্তরের ৩৮টি স্বর্ণপদক রয়েছে এই আখড়ায়। অলিম্পিক্সে (১৯৫২) কুস্তিতে প্রথম পদক জয়ী ভারতীয় কেডি যাদব এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। জোড়াবাগান পার্ক থেকে অলিম্পিক্সে গিয়েছেন নির্মল বসু, নিরঞ্জন দাস, রবিন হাজরা-সহ অনেকেই।
নিজের আখড়া নিয়ে গর্বিত শ্বেতা বলেন, ‘‘আমার গুরুজি (কোচ) খুবই ভাল প্রশিক্ষণ দেন। কিন্তু আরও ভাল কোচিং দরকার। কিন্তু সেই সুযোগ নেই এখানে। অর্থাভাবেই আমার মতো অনেকেই কুস্তিকে ভালবাসলেও এগোতে পারে না।’’ শ্বেতা জানান, কুস্তির ক্ষেত্রে একটা বড় বিষয় হচ্ছে খাওয়াদাওয়া। ভাল বলবর্ধক খাবার খুব জরুরি। শ্বেতা বলেন, ‘‘কুস্তি লড়তে গেলে অনেক দুধ, ঘি, মাখন খেতে হয়। দিনে কমপক্ষে হাফ ডজন ডিম খাওয়া দরকার। আরও অনেক কিছুই খেতে হয়। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমি তবু খাবার পেয়েছি। কিন্তু এখন কুস্তি শিখতে আসে মূলত গরিব বাড়ির ছেলেমেয়েরা। তারা বেশিদিন চালাতে পারে না। সত্যি করেই বলছি, কুস্তিতে বড্ড খিদে পায়।’’
শ্বেতার গুরুজি অসিত সাহা একইসঙ্গে রাজ্য কুস্তি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘‘শ্বেতার মতো মেয়েরা বাংলার সম্পদ। আরও ভাল কোচিং, আরও ভাল ম্যাট দরকার ওদের প্রশিক্ষণের জন্য। সুযোগ পেলে শুধু দেশের মধ্যে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বাংলার জন্য গর্ব ছিনিয়ে আনতে পারে এমন অনেক মেয়েই আছে বাংলায়। শ্বেতা তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা।’’ অসিত বলেন, ‘‘এমনিতেই কুস্তিতে আসা ছেলেমেয়ে সংখ্যায় কম হয়। তার উপরে সে ভাবে কোনও সরকারি সাহায্য নেই। আখড়া বা সংগঠন এক আধজনকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু সবার জন্য পরিকাঠামো দরকার। সেই সঙ্গে দরকার পর্যাপ্ত খাবার। সেই লড়াইটাও একক ভাবে সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।’’ একই সঙ্গে অসিতের অভিযোগ, ‘‘অতীতে জাতীয়স্তরের প্রতিযোগিতায় গেলে কুস্তিগিরদের গাড়ি ভাড়া ও খাওয়াদাওয়ার খরচ সরকারদিত। এখন সেটাও বন্ধ। এটা মানতেই হবে, সরকার পাশে না দাঁড়ালে অনেক প্রতিভা আড়ালে থেকে যাবে। হতাশা থেকে আখড়া ছেড়ে চলে যাবে। সেটা যাচ্ছেও।’’
বিদ্যাসাগর কলেজে স্নাতকস্তরে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী শ্বেতা ইতিমধ্যেই স্পোর্টস অথোরিটি অব ইন্ডিয়া (সাই) থেকে কোচিংয়ের কোর্স করেছেন। এখন একটা চাকরি দরকার। তিনি বললেন, ‘‘আমার বাবা খুবই অসুস্থ। কঠিন রোগে ভুগছেন। তাতেও আমার চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার রোজগার হলে নিজে যেমন কুস্তিতে আরও একটু মন দিতে পারব, তেমনই আমার ছোট যারা কুস্তিকে কেরিয়ার করতে চান, তাঁদের পাশেও দাঁড়াতে পারব।’’
একই কথা অসিতেরও। তিনি বলেন, ‘‘রেল থেকে আয়কর বিভাগ— সকলের কুস্তির দল রয়েছে। রাজ্য পুলিশেও কুস্তিতে সফলদের নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। শ্বেতার মতো কেউ চাকরি পেলেতা নজির তৈরি করবে। একজন সফল চাকরি পেলে অন্যদের মধ্যে কুস্তির প্রতি টানও বাড়বে। শ্বেতা যদি নিজের যোগ্যতায় চাকরি পায়, তবে বাকিদের ভরসা আসবে। আর আজকের দিনে সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে আর্থিক স্বীকৃতিও খুবই জরুরি। কুস্তিতে তো আর সহজে স্পনসর আসবে না। তাই সরকারি উদ্যোগ দরকার। তবে শ্বেতাদের জন্য কোনও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলেও স্বাগত।’’
শ্বেতা জানেন, খালি পেটে কুস্তি হয় না। কুস্তিতে নামলেই খিদে পায়। তবে শুধু নিজের নয়, সবার জন্য খাবার চান শ্বেতা। আর তার জন্য চান এমন একটা চাকরি,যা জীবনের প্রথম প্রেম কুস্তি থেকে দূরে সরিয়ে দেবে না। শ্বেতা আসলে যেখানেই থাকুন মনে মনে থাকেন ভালবাসার কুস্তির রিং-এ। সেই রিং-কে ঘিরেই তাঁর সব স্বপ্ন। যে স্বপ্ন আটকে রয়েছে রিং-এ নামার আগে পেট ভরে খাওয়ার চিন্তায়।