ইতিহাস গড়লেন রানি রামপালরা। ভারতীয় মেয়েদের হকিকে নিয়ে গেলেন নতুন উচ্চতায়। তবে সেই সাফল্যের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কঠিন লড়াই। একেক জনের উঠে আসার পিছনে রয়েছে একেক রকম কাহিনি। যা অনুপ্রেরণা দেবে আগামী প্রজন্মকে।
রানি রামপাল (২৬, স্ট্রাইকার): ভারতীয় দলের অধিনায়ক হরিয়ানার ২৬ বছরের রানি। সালওয়ার কামিজ পরে, ভাঙা হকিস্টিক নিয়েই খেলা শুরু করেছিলেন তিনি। ভারতের হয়ে অভিষেক ঘটে ১৫ বছর বয়সে। এখনও অবধি ২২৬টি ম্যাচে ১১২টি গোল করেছেন রানি। ভারতকে একাধিক ম্যাচে জয় এনে দিয়েছেন তিনি। ছোটবেলায় রোজ দু’বেলা খাবারও জুটত না। সেই রানির দিকেই এখন তাকিয়ে গোটা দেশ।
নেহা গোয়েল (২৪, মিডফিল্ডার): তাঁর মদ্যপ বাবার কাছে রোজ অপদস্থ হতে হত মাকে। সেই দৃশ্য যাতে না দেখতে হয় সেই জন্য হকি খেলা শুরু করেছিলেন নেহা। হকি খেললে দু’বেলা খাবার পেতেন। সেই কারণেও হকি খেলতেন তিনি। সেই মেয়েই এখন ভারতীয় দলের অন্যতম ভরসা। মায়ের সঙ্গে এক সাইকেল কারখানাতেও কাজ করতেন নেহা। চাকার একটা স্পোক ঠিক করার জন্য পাঁচ টাকা পেতেন তিনি। ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে নেহার।
নিক্কি প্রধান (২৭, ডিফেন্ডার): ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা থেকে উঠে এসেছেন নিক্কি। হকিস্টিক কেনারও টাকা ছিল না তাঁর। দিনমজুরি করে টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন হকিস্টিক। রাঁচির একাডেমিতে খেলার সময় প্রথম হকির জুতো পেয়েছিলেন তিনি। জাতীয় দলে নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছিলেন না একটা সময়। ২০১৫ সালের পর সেই সুযোগ আসে। রিয়ো অলিম্পিক্সে খেলার সুযোগ পান তিনি। ঝাড়খণ্ড থেকে তিনিই প্রথম খেলোয়াড়, যিনি অলিম্পিক্সে খেলেছেন।
নিশা ওয়ারশি (২৬, মিডফিল্ডার): মাত্র দু’বছর আগে অভিষেক ঘটে তাঁর। হকি খেলতে শুরু করেছিলেন কারণ এই খেলায় খুব বেশি সরঞ্জামের প্রয়োজন ছিল না। বাবা ছিলেন দর্জি। কিন্তু ২০১৫ সালে পঙ্গু হয়ে যান তিনি। অর্থাভাবের কারণে ফোম তৈরির কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন নিশার মা। তিন বছর পর ২০১৮ সালে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে নিশার।
লালরেমসিয়ামি (২১, স্ট্রাইকার): দলের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার এই তরুণী। সতীর্থরা সিয়ামি বলে ডাকেন তাঁকে। ১৬ বছর বয়সে যখন জাতীয় দলে সুযোগ পান তিনি, সেই সময় ইংরাজি বা হিন্দি কোনও ভাষাই জানতেন না সিয়ামি। ইঙ্গিতে কথা বলতেন সতীর্থদের সঙ্গে। রানি রামপালকে দেখে নিজেকে তৈরি করা সিয়ামি তাঁর সঙ্গেই ঘর ভাগ করে নিতেন। ২৫ বছরে মিজোরামের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে অলিম্পিক্সে খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
সুশীলা চানু (২৯, মিডফিল্ডার): টোকিয়ো অলিম্পিক্সে খেলতে যাওয়া ভারতীয় দলের অন্যতম অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। রিয়ো অলিম্পিক্সে অধিনায়ক ছিলেন তিনি। বহু দিন ধরে জাতীয় দলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। দেড়শোর বেশি ম্যাচ খেলেছেন সুশীলা। কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।
দীপ গ্রেস এক্কা (২৭, ডিফেন্ডার): ভারতীয় দলের প্রাক্তন গোলরক্ষক দীনেশের বোন এক্কা। হকির অনুপ্রেরণা পেয়েছেন দাদার থেকেই। ওড়িশার এক্কা দাদার পথেই পা বাড়ালেন। ২০১৭ সালে এশিয়া কাপজয়ী দলে ছিলেন তিনি। দুশোর বেশি ম্যাচ খেলা এক্কার এটা দ্বিতীয় অলিম্পিক্স। রিয়োর দলেও ছিলেন তিনি।
সালিমা তেতে (১৯, মিডফিল্ডার): তরুণ খেলোয়াড়ের হকির প্রতি ভালবাসা ছোট থেকেই। মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় জন্ম নেওয়া সালিমা এখনও অবধি ৩০টি ম্যাচ খেলেছেন। নিজে কাজ করে প্রথম হকিস্টিক কিনেছিলেন তিনি। শুক্রবার ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে নামবেন সালিমা।
উদিতা দুহান (২৩, ডিফেন্ডার): হকি নয়, তাঁর বাবার মতো হ্যান্ডবল খেলতে শুরু করেছিলেন উদিতা। কিন্তু স্কুলের হ্যান্ডবল প্রশিক্ষক স্কুল বন্ধ করে দিলেন। মায়ের কথায় তাই হকি খেলতে শুরু করেছিলেন উদিতা। তাঁর গতি নজর কাড়ে সকলের। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব ১৮ দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। পরের বছরেই সুযোগ পেয়ে যান বড়দের দলে।
বন্দনা কাটারিয়া (২৬, স্ট্রাইকার): গ্রুপের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার রাস্তা পাকা করেছিল ভারত। সেই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন বন্দনা। তিন মাস আগে বাবাকে হারিয়েছেন তিনি। যে বাবার জন্য তাঁর খেলার স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে মেয়েকে খেলতে পাঠিয়েছিলেন তিনি। অনুশীলন থাকায় বাবার শেষ সময় পাশে থাকতে পারেননি বন্দনা। অলিম্পিক্সে পদক জিতে বাবার লড়াইকে সম্মান জানাতে চাইবেন তিনি।
নবনীত কৌর (২৫, স্ট্রাইকার): রিয়ো অলিম্পিক্সে খেলা খেলোয়াড়দের মধ্যে আট জন রয়েছেন এই দলে। তাঁদের মধ্যে নবনীত একজন। ২০১৩ সালে যুব বিশ্বকাপ দলেও ছিলেন তিনি। হরিয়ানার এই মেয়ে বরাবর নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন। এ বারের অলিম্পিক্সে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নজর কেড়েছিলেন তিনি।
মনিকা মালিক (২৭, মিডফিল্ডার): তাঁর বাবা চণ্ডীগড় পুলিশের এএসআই। কুস্তি পছন্দ ছিল তাঁর। তবে মেয়ের ওপর কখনও চাপ দেননি কুস্তিতে যোগ দেওয়ার জন্য। হকি খেলার সিদ্ধান্ত নেন মনিকা। কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেন মনিকা। জাতীয় দলের অন্যতম খেলোয়াড় তিনি।
গুরজিৎ কৌর (২৫, ডিফেন্ডার): কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে গোল করেন গুরজিৎ। আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ সময় তাঁর এমন গোল ভারতকে জয় এনে দিয়েছে বহুবার। ২০১৭ সালে এশিয়া কাপ জয়ের পথে সাতটি গোল করেছিলেন তিনি। অনেক দূরের স্কুলে যেতে যাতে কষ্ট না হয়, সেই জন্য হস্টেলে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। সেখানে কাছেই ছিল হকির মাঠ। সেখানে অনেককে খেলতে দেখা ভালবেসে ফেলেন খেলাটাকে। সেই শুরু, তারপর থেকে আর থামেননি গুরজিৎ।
শর্মিলা দেবী (১৯, স্ট্রাইকার): ২০১৯ সালে টোকিয়োতেই অভিষেক ঘটে তাঁর। সেই টোকিয়োতেই এ বার খেলতে নেমেছেন তরুণ স্ট্রাইকার। আমেরিকাকে ৬-৫ গোলে হারানোর ম্যাচে স্কোরশিটে নাম তুলেছিলেন তিনি। নিজেকে ‘দুষ্টু মেয়ে’ বলেই পরিচয় দেন শর্মিলা। তাঁর দাদু জাতীয় পর্যায়ে হকি খেলেছেন। তবে হকিকে বেছে নেওয়ার আগে ভলিবল এবং ফুটবলও খেলেছেন শর্মিলা।
নবজ্যোত কৌর (২৬, মিডফিল্ডার): সন্তানদের একজন অন্তত খেলোয়াড় হোক, এটাই স্বপ্ন ছিল নবজ্যোতের বাবার। সেই স্বপ্নই সত্যি করেছেন নবজ্যোত। স্কুলে থাকাকালীন ২০০৩ সালেই অনুশীলন শুরু করেন তিনি। মিডফিল্ডার হলেও আক্রমণ ভাগকেও সাহায্য করেন নবজ্যোত। ৯ বছর আগে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে তাঁর। এশিয়ান গেমসে ২০১৪ সালে ব্রোঞ্জ এবং ২০১৮ সালে রুপো জেতেন তিনি। রিয়ো অলিম্পিক্সের দলেও খেলেছেন নবজ্যোত।
সবিতা পুনিয়া (৩১, গোলরক্ষক): হরিয়ানার সবিতা গোলরক্ষকের প্রশিক্ষণ নেবেন না বলে ঠিক করেছিলেন। কারণ গোলরক্ষক হলে প্রচুর বেশি সরঞ্জাম নিতে হয়। সেই নিয়ে বাসে উঠতে অসুবিধা হত তাঁর। গরমের মধ্যে এই পোশাক পরে থাকাও ছিল কষ্টের। কিন্তু এখন সবিতাই দলের প্রধান গোলরক্ষক। দাদুর উৎসাহে হকি খেলা শুরু করেন তিনি। তবে তাঁর বাবা প্রচুর খরচ করে হকির সরঞ্জাম কিনে দেওয়ার পরেই হকি খেলা নিয়ে আরও বেশি করে ভাবতে শুরু করেন সবিতা। এশিয়ান গেমসে পদক জয়ের সাক্ষী ছিলেন তিনিও।