ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের (বাঁ দিকে) পাশে যোগেশ্বর দত্ত (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়), অন্য দিকে বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক দিকে বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগট। অন্য দিকে ব্রিজভূষণ শরণ সিংহ, যোগেশ্বর দত্ত। জেলে না থাকলে সুশীল কুমারও হয়তো যোগ দিতেন দ্বিতীয় দলেই। এঁরা সবাই কুস্তির সঙ্গে যুক্ত। কেউ আখড়ায় নামেন। কেউ প্রশাসক। কিন্তু এখন তাঁরা যুযুধান দুই পক্ষ। বজরং, সাক্ষীরা অভিযোগ করছেন, ভারতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি ব্রিজভূষণ এক নাবালিকা-সহ বেশি কয়েক জন মহিলা কুস্তিগিরকে হেনস্থা করেছেন। তাঁকে গ্রেফতার করার দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন বজরংরা। পাল্টা ব্রিজভূষণ আবার জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অসত্য। কুস্তিগিরেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছেন। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, লড়াইটা কি সত্যিই ন্যায়বিচারের? না কি এর পিছনেও রয়েছে ক্ষমতার লড়াই!
কুস্তির সঙ্গে যুক্ত একটি পক্ষের মতে, লড়াইটা মূলত হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের। কুস্তি সংস্থার ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, সেটাই প্রধান লক্ষ্য। ক্ষমতা দখলের প্রবল ইচ্ছা দু’টি কারণে। এক, অলিম্পিক্স-সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজের পছন্দের খেলোয়াড়কে দলে ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ। দুই, সংস্থার আর্থিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখা।
ব্রিজভূষণ উত্তরপ্রদেশের। যোগেশ্বর, সুশীলরা দিল্লির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অন্য দিকে বজরং, সাক্ষী, বিনেশরা হরিয়ানার। দেশের বেশির ভাগ কুস্তিগির হরিয়ানার হলেও ফেডারেশনের মাথায় তাঁদের প্রতিনিধি না থাকায় নাকি ক্ষুব্ধ বজরংরা। সেই কারণেই ব্রিজভূষণকে সরাতে এতটা মরিয়া চেষ্টা করছেন তাঁরা। কুস্তিগিরেরা যখন প্রথম বিক্ষোভ শুরু করেন তখন ব্রিজভূষণ দাবি করেছিলেন, ট্রায়ালে অংশ না নিয়েই নাকি অলিম্পিক্স, কমনওয়েলথ গেমসে খেলতে চান বজরংরা। তিনি সেটা বন্ধ করেছেন। তাঁর আমলে নাম বা খ্যাতি না দেখে দেশের সব জায়গা থেকে প্রতিভাবান কুস্তিগিরেরা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন। সেই কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে।
অপর একটি পক্ষ আবার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তাঁদের মতে, ব্রিজভূষণ একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছেন। বিশ্ব কুস্তি সংস্থা বার বার নির্দেশ দেওয়ার পরেও তিনি ফেডারেশনে নির্বাচন করাচ্ছেন না। কারণ তিনি জানেন, নির্বাচন হলে ক্ষমতা তাঁর হাত থেকে চলে যাবে। নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ব কুস্তি সংস্থা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে ভারতীয় কুস্তি সংস্থাকে বরখাস্ত করা হবে। তার পরেও কুছ পরোয়া নেই ব্রিজভূষণের। তিনি নিজের পছন্দের কুস্তিগিরদের বাড়তি সুবিধা করে দিচ্ছেন। বিজেপি সাংসদ হওয়ায় কাউকে ভয় পান না তিনি। আগেও একাধিক বার বিতর্কে জড়িয়েছেন ব্রিজভূষণ। মঞ্চে উঠে এক কুস্তিগিরকে থাপ্পড় মারারও অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সেই কারণেই ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে নাকি আন্দোলন চালাচ্ছেন বজরংরা।
এর মধ্যেই ঘটনায় ঢুকে পড়েছেন কৃষকনেতারা। তাঁরা কুস্তিগিরদের পরামর্শ দিচ্ছেন। হরিদ্বারে গঙ্গায় কুস্তিগিরেরা পদক ভাসাতে গিয়েও কৃষকনেতাদের পরামর্শেই ফিরে এসেছেন তাঁরা। ভারতীয় কিসান মোর্চার প্রধান নরেশ টিকায়েতের হাতে নিজেদের পদক তুলে দিয়েছেন সাক্ষীরা। বৃহস্পতিবার বৈঠক ডেকেছেন কৃষক নেতারা। সেখানে পঞ্জাব, হরিয়ানার বিভিন্ন কৃষক সংগঠন যোগ দেবে বলে জানিয়েছে। সেই বৈঠকে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন তাঁরা। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রকে পাঁচ দিনের সময়সীমা দিয়েছেন কুস্তিগিরেরা। কিন্তু কেন্দ্র চুপ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে বিজেপির কোনও মন্ত্রীকে মুখ খুলতে দেখা যায়নি।
হরিদ্বারের এই ঘটনা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। তাঁদের মতে, যদি গঙ্গায় পদক ভাসাতেই সাক্ষীরা গিয়েছিলেন, তা হলে সেখানে গিয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা কেন অপেক্ষা করলেন তাঁরা। চুপচাপ বসে থাকলেন। তার পরে কৃষকনেতারা এসে তাঁদের নিয়ে গেলেন। তা হলে কি আগে থেকেই পুরোটা সাজানো ছিল? তাঁরা জানতেন যে কৃষকনেতারা আসবেন? শুধুমাত্র সবার চোখ নিজেদের দিকে টানার জন্যই কি এই নাটক হল? প্রশ্ন উঠছে।
সামনেই এশিয়ান গেমস। আপাতত সে দিকে তাকাচ্ছেন না কুস্তিগিরেরা। অলিম্পিক্সে পদকজয়ী বজরং জানিয়েছেন, এশিয়ান গেমসের থেকে ন্যায়বিচার তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অলিম্পিক্সে আর এক পদকজয়ী কুস্তিগির তথা বিজেপি নেতা যোগেশ্বর আবার বিক্ষোভরত কুস্তিগিরদের পরামর্শ দিয়েছেন, আন্দোলন না করে এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি নিতে। পাল্টা অভিযোগ উঠেছে বজরংদের বিরুদ্ধেও। এক সাবালিকা কুস্তিগিরের কাকা অভিযোগ করেছেন, ব্রিজভূষণকে ফাঁসানোর জন্যই নাকি তাঁর ভাইঝির বয়স কমিয়েছেন বজরংরা। তাঁদের ভুল বুঝিয়ে অভিযোগ করানো হয়েছে। এর মধ্যেই দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করলেও তাঁকে গ্রেফতার করার মতো কোনও প্রমাণ তাঁরা পাননি। ফলে এখনই এই ঘটনা থামার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এই পুরো ঘটনার নেপথ্যে কি শুধুই রাজনীতি আর ক্ষমতার লড়াই? যেখানে কেউ কাউকে একটু জায়গাও ছেড়ে দিতে চাইছেন না? এক দিকে এশিয়ান গেমস, দেশের প্রতিনিধিত্ব, এ সব ভুলে শুধু আন্দোলন করছেন কুস্তিগিরেরা। অন্য দিকে দেশের কুস্তির উন্নতির কথা না বলে পাল্টা অভিযোগ করছেন ব্রিজভূষণ। আর তাতে ঢুকে পড়েছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সব মিলিয়ে আরও জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। এতে কি আখেরে কুস্তির ক্ষতি হচ্ছে না? যে খেলায় আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ভারত দাপট দেখায় সেই খেলাতেও কি পিছিয়ে পড়ছে ভারত?
ঘটনার সূত্রপাত জানুয়ারি মাসে। ব্রিজভূষণের অপসারণ ও গ্রেফতারির দাবিতে যন্তর মন্তরে ধর্না শুরু করেন বজরং, সাক্ষীরা। তিন দিন ধরে চলে সেই ধর্না। সেই সময় ধর্না তুলে নিলেও গত ২৩ এপ্রিল দ্বিতীয় বারের জন্য ধর্না শুরু করেন বজরংরা। তাঁদের অভিযোগ, প্রথম বার ধর্নার পরে তাঁরা ভেবেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার পদক্ষেপ করবে। কিন্তু না করায় তাঁরা আবার আন্দোলন শুরু করেছেন। সেই আন্দোলন এখনও চলছে। মাঝে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন কুস্তিগিরেরা। কিন্তু কুস্তিগিরদের আন্দোলন শুধু কুস্তিগিরদের মধ্যেই থেমে থাকেনি। ধীরে ধীরে সেখানে যোগ দিতে শুরু করেছেন রাজনৈতিক নেতারা। তার পরেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে।
বজরংরা আন্দোলনে পাশে পেয়েছেন কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম, আম আদমি পার্টির মতো বিরোধী দলকে। দূরত্ব রেখে চলছে বিজেপি। নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের দিন মিছিল করতে গিয়ে আটক হয়েছেন সাক্ষীরা। তাঁদের টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলেছে দিল্লি পুলিশ। এই ঘটনার পরে বিরোধী দলগুলি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আরও সুর চড়িয়েছে। কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন কয়েক জন প্রাক্তন ক্রীড়াবিদ (সেই তালিকায় অবশ্য সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়রা নেই)। বর্তমান ক্রীড়াবিদদের মধ্যে সুনীল ছেত্রী ছাড়া তেমন কেউ এখনও মুখ খোলেননি। তাঁরাও কি বুঝতে পারছেন, পুরো লড়াইটা আসলে রাজনীতির! পাঁচ বারের বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে মুখ খোলা মানে কি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলা? সেই কারণে এই বিবাদে যেতে চাইছেন না? প্রশ্ন কিন্তু উঠছে।