চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর কুর্তোয়া। ছবি: রয়টার্স
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল শুরু হতে প্রায় ৪৫ মিনিট দেরি। ভারতীয় সময় রাত ১২টা ৩৫ মিনিট নাগাদ অনুশীলন করতে মাঠে ঢুকছিল রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল। সেই সময় রিয়াল মাদ্রিদের গোলরক্ষক থিবো কুর্তোয়া ছিলেন সকলের আগে। তাঁর মুখে এক রাশ বিরক্তি। যে সময় খেলা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেই সময় পার করে অনুশীলন করতে ঢুকতে হচ্ছে। বেলজিয়ামের গোলরক্ষক আর অপেক্ষা করতে চাইছিলেন না। তিনি মাঠে নামতে চাইছিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে খেলতে চাইছিলেন।
শনিবারের আগে রিয়াল মাদ্রিদ শেষ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিল ২০১৮ সালে। সেই বছরই কুর্তোয়াকে সই করায় স্প্যানিশ ক্লাব। তাঁকে যখন রিয়াল মাদ্রিদ সই করায়, অনেক সমর্থকের মনে দেখা দিয়েছিল আশঙ্কা। কারণ ২০১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে চেলসির হয়ে খেলার সময় বার্সেলোনার বিরুদ্ধে তিনটি গোল খান কুর্তোয়া। এর মধ্যে লিয়োনেল মেসির করা দুটো গোল খেয়েছিলেন পায়ের ফাঁক দিয়ে। বার্সেলোনার সঙ্গে একই লিগে খেলা রিয়াল মাদ্রিদ তাঁকে নিচ্ছে দেখে আঁতকে ওঠেন সমর্থকরা। তাঁর গোল খাওয়ার ধরন নিয়ে তৈরি হয়েছিল মিম। যদিও সেই বছরের বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের হয়ে সোনার গ্লাভস জিতে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
চার ধরনের ভাষায় পারদর্শী কুর্তোয়ার জন্ম বেলজিয়ামের ব্রি নামক একটি শহরে। তাঁর দিদি ভেলেরি কুর্তোয়া একজন ভলিবল খেলোয়াড়। বেলজিয়ামের হয়ে খেলেন তিনিও। তাঁদের মা-বাবাও ভলিবল খেলতেন। কুর্তোয়া নিজেও ছোট বেলায় ভলিবল খেলতে শুরু করেন। কিন্তু ১২ বছর বয়সে তিনি ঠিক করেন যে ভলিবল নয়, ফুটবল খেলায় মন দেবেন। ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলার পরিবেশে বড় হওয়া কুর্তোয়া জানেন অপমানের জবাব মাঠেই ফিরিয়ে দিতে হয়। আর জেতার জন্য আগে থেকেই মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। তাই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলতে নামার আগে বলেছিলেন, “রিয়াল মাদ্রিদ ফাইনাল খেললে তারা জিতবেই। ইতিহাস তাই বলছে।”
শুধু মুখে বলা নয়, কাজেও করে দেখালেন কুর্তোয়া। মাদ্রিদের ১৪তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পিছনে বড় ভূমিকা নিলেন তিনি। ফাইনালে মোট ন’টি গোল বাঁচান কুর্তোয়া। প্রথমার্ধে লিভারপুল একাধিক আক্রমণ করে এবং বার বার মহম্মদ সালাহ, সাদিয়ো মানেদের আক্রমণ ধাক্কা খায় কুর্তোয়া নামক এক দেওয়ালে।
ফাইনালের সেরা ফুটবলার কুর্তোয়া ম্যাচ শেষে বলেন, “অনেকে আমাকে টুইট করে নম্র হতে বলেছিলেন। কিন্তু এখন উল্টো পরিস্থিতি। আমি যা পরিশ্রম করেছি তাতে একটা ফাইনাল আমাকে জিততেই হত।” চেলসির হয়ে ২০১৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর ইংল্যান্ডে যে অপমান তাঁকে করা হয়, সেই সব কিছুর উত্তর দিতে চেয়েছিলেন কুর্তোয়া। উত্তরটা মাঠে দিতে চেয়েছিলেন। চেলসি তাঁকে ছাড়তে চায়নি। কিন্তু তিনি ইংল্যান্ডে থাকতে চাননি। চেলসি তাঁর পরিবর্ত না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না বলায় তিনি অনুশীলনে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর পরেই রিয়াল মাদ্রিদ তাঁকে সই করিয়েছিল। নতুন দলকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিলেন তিনি। কুর্তোয়া বলেন, “নিজের নামের প্রতি সুবিচার করার জন্য আমাকে একটা ফাইনাল জিততেই হত। কারণ আমার মনে হয় না আমি সঠিক সম্মান পেয়েছি, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে।” শনিবার ইংল্যান্ডের ক্লাবকে হারিয়েই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে রিয়াল মাদ্রিদ।
কুর্তোয়ার প্রশংসা করেন কোচ কার্লো আন্সেলত্তিও। তিনি বলেন, “এমন গোলরক্ষা আগেও দেখেছি। সেটাও কুর্তোয়ারই দুর্গরক্ষা।” বিশ্বকাপে সোনার গ্লাভস জেতার পরেও তাঁকে কখনও সেরা গোলরক্ষকদের স্থানে বসানো হয়নি। সমর্থকদের মধ্যেও কখনও কুর্তোয়াকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা যায় না। বরং রিয়াল মাদ্রিদে এসে তাঁর সব চেয়ে খারাপ স্মৃতিটাই বার বার মনে পড়ে যেত।
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে খেলার সময় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে শেষ মুহূর্তে রিয়াল মাদ্রিদের সের্খিয়ো র্যামোসের হেডে গোল খান কুর্তোয়া। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। কুর্তোয়ার দল হেরে যায় ১-৪ ব্যবধানে। এক সাক্ষাৎকারে কুর্তোয়াকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তিনি যদি কোনও একটা সময় পিছনে ফিরে গিয়ে তাঁর একটা কাজ বদলাতে চান তা হলে সেটা কোনটি? কুর্তোয়া বলেন, “আমি র্যামোসের ওই হেডটা আটকাতে চাইতাম।” ভাগ্যের কী পরিহাস, মাদ্রিদে এসে তিনি দেখেন দলের সাজঘরে র্যামোসের সেই গোলের ছবি লাগানো রয়েছে। র্যামোসের সাফল্যকে তুলে ধরার জন্যই লাগানো রয়েছে সেই ছবি।
এ বার হয়তো কুর্তোয়ার ছবি লাগানো থাকবে সেই সাজঘরে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।