স্পেনের নতুন ফুটবল তারকা লামিনে ইয়ামাল। ছবি: এএফপি
ইউরো কাপে ফুটবলের মাঠে ‘সাবালক’ হলেন লেমিনে ইয়ামাল। স্পেনের ১৬ বছরের ফুটবলারকে এত দিন সকলে বলতেন দুর্দান্ত প্রতিভা। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইউরো সেমিফাইনালে সেই প্রতিভার ঝলক দেখল ফুটবল বিশ্ব। গোল করলেন। বার বার সুযোগ তৈরি করলেন। ইউরোর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হওয়ার নজির গড়লেন। এই সবের সঙ্গেই বুঝিয়ে দিলেন, শুধুমাত্র প্রতিভা হয়ে থাকতে আসেননি। আগামী বেশ কয়েক বছর শাসন করতে চান ফুটবল বিশ্বকে।
ফুটবলজীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে লিয়োনেল মেসি। তাঁর অবসরের আগেই বিশ্ব ফুটবলকে বার্সেলোনার উপহার ইয়ামাল। মেসির মতোই বার্সেলোনার অ্যাকাডেমি লা মাসিয়ায় ফুটবলে পায়ে খড়ি স্পেনের ১৬ বছরের উইঙ্গারের। স্পেনের অনূর্ধ্ব ১৫, ১৬, ১৭, ১৯ সব দলের হয়ে খেলেছেন। জাতীয় দলের হয়েও খেলে ফেললেন ১৩টি ম্যাচ।
শুধু ভাল ফুটবলার নয়, ফুটবলের জাদুকর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে ইয়ামালের মধ্যে। ইউরো সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তাঁর গোলই প্রমাণ। ম্যাচের বয়স তখন ২১ মিনিট। ফ্রান্সের বক্সের বাইরে বল পান ১৬ বছরের ফুটবলার। প্রতিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারকে নাস্তানাবুদ করেই গোলের গন্ধ পেয়ে যান। তাঁর বাঁ পায়ের বাঁক খাওয়ানো শট আটকাতে পারেননি ফ্রান্সের গোলরক্ষক মাইক মাইগানান। তিনি আসলে কোনও সময়ই পাননি। ইয়ামালের গোল চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁর সতীর্থ পেদ্রি। এমন গোলও সম্ভব! ইয়ামালের পক্ষেই বোধহয় সম্ভব। রিজার্ভ বেঞ্চে বসা পেদ্রির বিস্ময় ভরা চোখ আর দু’গালে হাত দেওয়া মুখের ছবি ভাইরাল হতে সময় লাগেনি।
বড় ফুটবলারেরা বোধ হয় এমনই হন। আপাত-সাধারণ পরিস্থিতিকে গোলের সুযোগে পরিণত করতে পারেন। মাঠে নিজের এবং অন্য ফুটবলারদের অবস্থান মুহূর্তে জরিপ করে ম্যাচের রং বদলে দিতে পারেন। মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের সঙ্গে তুলনা করার মতো জায়গায় এখনও আসেননি। কয়েক বছরের মধ্যে সেই জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারেন ফুটবলের নতুন বিস্ময়।
স্পেনের মাটারা প্রদেশে এক উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম ইয়ামালের। দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা। ইয়ামালের বাবা মরক্কোর মানুষ। মা আফ্রিকার ছোট্ট দেশ ইকোয়াটোরিয়াল গিনির। জন্মের পর থেকে তাঁর জীবন সহজ ছিল না। বিভিন্ন সময় তাঁর পরিবারকে বাস বদলাতে হয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই বিকশিত হয়েছে তাঁর ফুটবল প্রতিভা। সাত বছর বয়সে লা মাসিয়ায় যাওয়ার আগেই ফুটবলার ইয়ামালকে চিনে ফেলেছিল মাটারার অলিগলি। পাড়ায় পাড়ায় ‘সেভেন এ সাইড’ ফুটবল খেলতেন তিনি। খেলতেন বড়দের সঙ্গেই। ২০১৪ সাল থেকে বার্সেলোনায় স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করে ইয়ামালের পরিবার। তখন তাঁকে ভর্তি করানো হয় বার্সেলোনার ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। সেখানেও প্রথম থেকেই নজর কেড়ে নেয় তাঁর প্রতিভা। স্পেনের প্রতিটি বয়সভিত্তিক দলের হয়ে প্রতিভার পরিচয় দেওয়া ইয়ামালকে ছোট বয়সেই জাতীয় দলের হয়ে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিল মরক্কোর ফুটবল সংস্থা। ইয়ামাল বেছে নিয়েছেন নিজের জন্মভূমিকে। স্পেনের জল-হাওয়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয় জন্ম থেকে। নিজেকে স্পেনীয় ভাবতেই পছন্দ করেন। বাবা-মায়ের মিশ্র সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা ‘উদ্বাস্তু’ ইয়ামালকে নিজের করে নিতে দু’বার ভাবেনি স্পেনও।
ইয়ামালের পেশাদার ফুটবলজীবন শুরু ২০২৩ সালে। সবেই শুরু করেছেন। বলা যায় ফুটবলজীবনের চৌকাঠ পেরিয়েছেন সবে। চৌকাঠে দাঁড়িয়েই যে কেরামতি দেখাচ্ছেন, তাতে নিশ্চিত ভাবে বহু জাদু দেখাবে তাঁর বাঁ পা। বাঁ পায়ের ফুটবলারদের খেলা একটু বেশিই নান্দনিক হয়। ইয়ামালও ব্যতিক্রম নন।
গত ইউরো কাপের সময় ইয়ামালের বয়স ছিল ১৩। সেমিফাইনালে ইটালির কাছে হেরে গিয়েছিল স্পেন। বন্ধুদের সঙ্গে শপিং সেন্টারে দাঁড়িয়ে ইয়ামাল দেখেছিলেন দেশের হার। টাইব্রেকারে প্রথম শটে গোল করতে পারেননি ডানি ওলমো। ম্যাচের সেরা ফুটবলার হয়েও দেশকে কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দিতে পারেননি। তখন থেকেই ইয়ামাল স্বপ্ন দেখতেন দেশকে ইউরো কাপ জেতানোর।
এ বারের ইউরো খেলতে এসে সমস্যায় পড়েছেন ইয়ামাল। জার্মানির শিশুশ্রম আইনের কবলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। ৯০ মিনিট তাঁকে মাঠে রাখা যাচ্ছে না। স্পেনের কোচ লুইস ডে লা ফুয়েন্তে তাঁকে তুলে নিচ্ছেন সুযোগ মতো। জার্মানির শিশুশ্রম আইন অনুযায়ী, নাবালকদের স্থানীয় সময় রাত ৮টার পরে কাজ করানো বেআইনি। খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে সময়সীমা রাত ১১টা পর্যন্ত। যে সময় খেলা শুরু হচ্ছে, তাতে পুরো ৯০ মিনিট খেলালে জার্মানির আইন অনুযায়ী ম্যাচ প্রতি ২৭ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে স্পেনকে। এই কড়া আইনও রুখতে পারছে না তাঁকে। সেমিফাইনালে যেমন পারল না কিলিয়ান এমবাপের ফ্রান্স। যদিও ফুয়েন্তে জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রয়োজন মনে করলে পুরো ম্যাচই খেলাবেন ইয়ামালকে। জরিমানা দিতে হলে দেবেন। আইনের তোয়াক্কা করবেন না। আইনের প্যাঁচে ফেলে তাঁর সেরা অস্ত্রকে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা সফল হতে দেবেন না।
গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলিতে গোল করতে পারেননি ইয়ামাল। গোল পাননি নক আউট পর্বের প্রথম দু’ম্যাচেও। ১৬ বছরের ফুটবলার খেলতে পারছিলেন না এমন নয়। দলের সাফল্যে ধারাবাহিক ভাবে অবদান রাখছিলেন তিনি। গোল করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছিলেন সতীর্থদের। প্রতিপক্ষের রক্ষণকে বোকা বানাচ্ছিলেন। যা যা করা সম্ভব সব করছিলেন। সেমিফাইনালে নিজে গোল করলেন। গত বার শেষ চারের বাধা টপকাতে ব্যর্থ স্পেনকে তুলে দিলেন ফাইনালে।
গত বার টাইব্রেকারে গোল করতে না পারা ওলমো এ বারও দলে আছেন। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দলের দ্বিতীয় গোলটি তাঁরই। ওলমোর পাশে খেলেই ইয়ামাল বুঝিয়ে দিলেন তিনি আলাদা। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি আর ফুটবল দক্ষতাকে টক্কর দেওয়া কঠিন। বেশ কঠিন। স্পেনের দু’টি গোল হয়েছে চার মিনিটের তফাতে। ২১ মিনিটে ইয়ামাল সমতায় ফেরান ৯ মিনিটের মাথায় কোলো মুয়ানির গোলে পিছিয়ে পড়া স্পেনকে। ২৫ মিনিটে ওলমোর পা থেকে এসেছে দ্বিতীয় গোল। তাতে আরও স্পষ্ট হয়েছে পার্থক্য।
১৬ বছর ৩৬২ দিনের ইয়ামাল স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। নিজের ১৮তম জন্মদিনে ইউরো ফাইনাল। সে দিন স্পেনকে চ্যাম্পিয়ন করতে চান। প্রতিযোগিতার মাঝেই স্কুলের পরীক্ষা দিয়েছেন। অনুশীলন, ম্যাচ খেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াশোনাও করতে হয়েছে। পাশও করেছেন পরীক্ষায়। ইউরোর নকআউটের আগে পরীক্ষার ফল স্বস্তি দিয়েছিল ১৬ বছরের ফুটবলারকে। আরও একটা পরীক্ষায় পাশ করতে চান। আগামী রবিবার ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরীক্ষায়।
কয়েক দিন আগে ইয়ামালের মা সমাজমাধ্যমে একটি ছবি ভাগ করে নিয়েছিলেন ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তরুণ মেসির কোলে কয়েক মাসের ইয়ামাল। ২০০৭ সালে স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন বার্সেলোনার ফুটবলারেরা। ইউনিসেফের ক্যালেন্ডারের জন্য ছবি তোলা হয়েছিল। কাকতালীয় ভাবে মেসির কোলে উঠেছিলেন ইয়ামাল। তখনই বোধহয় তাঁর মধ্যে ভবিষ্যতের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন ফুটবল ঈশ্বর। মেসির মাধ্যমেই হয়তো ইয়ামালের মজ্জায়, রক্তে মিশিয়ে দিয়েছিলেন খেলা। ১৫ বছর ৯ মাস ১৬ দিন বয়সে লা লিগায় ইয়ামালকে নামিয়ে দিয়েছিল বার্সেলোনা। গত বছর সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন ৮৩ মিনিটে। ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে পা রেখেছিলেন তরুণ জাদুকর।
বার্সেলোনার পরিচয়ে আলাদা মাত্রা যোগ করেছিলেন মেসি। ইয়ামালও নতুন মাত্রা যোগ করছেন। লা মাসিয়ার মাটি, জল, বাতাস বোধহয় সেরা ফুটবলার তৈরি করার জন্য আদর্শ। তারকার জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে না লা মাসিয়া। মহাতারকাদের উত্থানের ভিতও গড়ে দেয়। যে ভিতের উপর দাঁড়িয়ে বিশ্ব শাসন করা যায়।
ফুটবল কথা শোনে অনেকেরই। তবে অনুসরণ করে হাতেগোনা কয়েক জনকে। ইয়ামাল ঠিক সেই প্রজাতির খেলোয়াড়। বলই বোধহয় তাঁর সঙ্গ ছাড়তে চায় না! রবার্ট লেয়নডস্কির মতো ফুটবলারের পাশে বার্সেলোনায় অভিষেক ইয়ামালের। ইউরো কাপের সেমিফাইনালে হেরে তাঁর সম্পর্কে ফ্রান্সের মিডফিল্ডার অ্যাড্রিয়েন রাবিয়ট বলেছেন, ‘‘ও এমন এক জন ফুটবলার যে সহজে চাপ সামলাতে পারে। ক্লাবের হয়ে সফল। ইউরো কাপের মতো বড় প্রতিযোগিতাতেও মাথা ঠান্ডা রেখে খেলছে। আমরা চেয়েছিলাম ওকে সমস্যায় ফেলতে। স্বস্তিতে খেলতে দিতে চাইনি। চাপে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। তা-ও আটকানো যায়নি।’’ আর নিজের গোল নিয়ে ইয়ামালের সরল বক্তব্য, ‘‘ম্যাচের শুরুতেই গোল খেয়ে যাব কেউই আশা করিনি। চাপে ছিলাম আমরা। ওই সময় মাথা তুলে মনে হল একটা সম্ভাবনা আছে। শুধু সঠিক জায়গায় বলটা রাখার চেষ্টা করছিলাম। গোল হবে ভাবিনি। গোল পেয়ে খুব খুশি হয়েছি।’’ সতীর্থ রড্রি বলেছেন, ‘‘ইয়ামাল যা করেছে, খুব কম খেলোয়াড় তা করতে পারে। ওর অসাধারণ গোলটার জন্যই মানুষ এই ম্যাচটা মনে রাখবে। দলের রক্ষণকেও সমান ভাবে সাহায্য করে ইয়ামাল। এই বয়সে এমন ফুটবল ভাবাই যায় না।’’ প্রশংসা করেছেন ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশঁও। তিনি বলেছেন, ‘‘দুর্দান্ত শট। ওই একটা শটই আমাদের প্রায় শেষ করে দিয়েছে।’’ আর স্পেনের কোচের ছোট্ট টিপ্পনী, ‘‘এক প্রতিভার ঝলক দেখা গেল।’’ ঝলকই বটে। বড় ম্যাচেই তো তারকার জন্ম হয়।
খুব বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না ইয়ামাল। নিজের মতো থাকতে ভালবাসেন। আর পাঁচজন সাধারণ কিশোরের মতো অবসর সময়ে ভিডিয়ো গেম খেলেন। তবে মাঠে নামলে কথা বলে তাঁর পা। সক্রিয় ফুটবল-মস্তিষ্ক মুহূর্তে সঙ্কেত পাঠায় কী করতে হবে। চোখ খুঁজে নেয় সতীর্থদের অথবা গোল। ইয়ামাল বলেছেন, ‘‘সেমিফাইনালে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি। প্রথম থেকে আমার লক্ষ্য ছিল, জার্মানিতে জন্মদিন পালন করার। মাকে বলে এসেছি, ফাইনালে জিতলে আমার জন্য কোনও উপহার কিনতে হবে না। এ বারের জন্মদিনটা সতীর্থদের সঙ্গেই উদ্যাপন করতে চাই।’’
সমাজমাধ্যমে দাবা বোর্ডের ছবি দিয়ে ইয়ামাল লিখেছেন, ‘‘চুপচাপ এগিয়ে চলো। শুধু চেকমেট হওয়ার সময় কথা বলো।’’ কথা বলছে ইয়ামালের বাঁ পা। কথা শুরু হয়েছে ফুটবল আলোচনাতেও। কোপা আমেরিকায় ব্যস্ত মেসিও নিশ্চয়ই নজর রাখছেন। লা মাসিয়ার উত্তরসূরিকে দেখে হয়তো তৃপ্তও হচ্ছেন। দু’জনের আঁতুড়ঘর তো একই। ছোটবেলার মাঠ, ঘাস, ক্লাব— সব এক। তারকা নয়, আরও এক মহাতারকার জন্ম। আলো তো ছড়াবেই।