প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হারলেও মেসির বিশ্বকাপ জয় নিয়ে আশাবাদী উত্তম। ছবি: টুইটার।
বাঙালির ফুটবল মানেই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। বৃহত্তর অর্থে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল। কলকাতা ডার্বিতে বাঙালি যেমন দু’ভাগ হয়ে যায়, বিশ্বকাপ ফুটবল হলেও তেমন। আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যায় ফুটবলপ্রেমী বাঙালি। যাদবপুরের উত্তম সাহা তেমনই এক জন। তিনি আর্জেন্টিনার সমর্থক।
হালফিলে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করছেন তেমন নয়। তিনি আর্জেন্টিনার বহু দিনের সমর্থক। ১৯৭৮ সাল থেকে নীল-সাদা ফুটবলের ভক্ত উত্তম। তখনও ফুটবল বিশ্ব দিয়েগো মারাদোনার সঙ্গে তেমন ভাবে পরিচিত নয়। তিনি তখন নেহাতই উদীয়মান ফুটবলার। দলে থাকলেও সে বার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাননি মারাদোনা। তবু প্রথম বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনা। পরে ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় বার মারাদোনার হাত ধরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। সময়ের নিয়মে মারাদোনা প্রাক্তন হয়েছেন। প্রয়াত হয়েছেন। ব্যাটন দিয়ে গিয়েছেন লিয়োনেল মেসির হাত। উত্তমও মজেছেন মেসি জাদুতে। যাদবপুরের গাঙ্গুলি বাগানের বাসিন্দা সারা বছর মগ্ন থাকেন আর্জেন্টিনার ফুটবলে।
মারাদোনা, মেসিতে। মাঠে বসে হোক বা টেলিভিশনে, আর্জেন্টিনা এবং মেসির কোনও খেলা বাদ দেন না। পেশায় ব্যবসায়ী উত্তম মেসির খেলা দেখার জন্য মাঝেমাঝেই উঠে পড়েন বিমানে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ, লা লিগা, অলিম্পিক্স— যখন যেখানে পেরেছেন ছুটে গিয়েছেন মেসির জন্য গলা ফাটাতে। মাঠে বসে মেসির ২৮টি ম্যাচ দেখেছেন উত্তম। ২০১১ সালে বাবার মৃত্যুর কয়েক দিন পরেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে মেসির খেলা ছিল। এক দিনের জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কাজ করেছিলেন। বেজিং অলিম্পিক্সে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল ম্যাচ দেখতে চলে গিয়েছিলেন স্ত্রী, পুত্রকে নিয়ে। সারাক্ষণ উত্তমের নজরবন্দি মেসি।
২০০২ সালে গড়ে তুলেছেন অর্জেন্টিনা ফুটবল ফ্যান ক্লাব। প্রায় ৮০০ সদস্য এই ক্লাবে। তাঁরা ছড়িয়ে আছেন ভারতের নানা শহরে। একাধিক দেশেও। সদস্যরা তো আছেনই। আছেন বন্ধু বা পড়শিরাও। সকলকে নিয়ে মেতে ওঠেন মারাদোনা, মেসির জন্মদিনে। কেক কাটা হয়। মিষ্টিমুখ করান সকলকে। তাঁর গাড়ির রংও আর্জেন্টিনার নীল-সাদা। গাড়িতেও সর্বক্ষণের সঙ্গী মারাদোনা এবং মেসি। শুধু ফুটবল নিয়ে মেতে থাকা নয়, সারা বছর নানা সমাজসেবামূলক কাজও করে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফ্যান ক্লাব।
শুক্রবার কাতার উড়ে গেলেন বিশ্বকাপের খেলা দেখতে। আসলে আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে। আরও ভেঙে বললে মেসির খেলা দেখতে। গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার সম্ভাব্য সব ম্যাচের টিকিট উত্তমের পকেটে। কিন্তু মেসিরা তো প্রথম ম্যাচেই হেরে গিয়েছেন তুলনায় দুর্বল সৌদি আরবের কাছে। তা নিয়ে চিন্তিত নন উত্তম। মারাদোনার মৃত্যুদিনে তাঁর ছবিতে মালা দিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন উত্তম। কাতার যাওয়ার আগে আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘প্রথম ম্যাচে হেরেছে বলে হিসাবের বাইরে রাখলে হবে না। এ বার মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনাই চ্যাম্পিয়ন হবে। হ্যাঁ, প্রথম ম্যাচটা ভাল খেলতে পারেনি। হয়তো একটু হালকা ভাবে নিয়ে ফেলেছিল। এখন মেসিদের কাছে সব ম্যাচই নকআউটের মতো। আমার বিশ্বাস আর কোনও ম্যাচ হারবে না আর্জেন্টিনা।’’
উত্তম বিশ্বাস করেন মেসিই বিশ্বের সেরা ফুটবলার। তাঁর কাছে এক থেকে ১০ শুধু মেসি। দ্বিতীয় কে? ভাবতে চান না তিনি। ৫৯ বছরের উত্তমের সঙ্গে মেসির একটি মিল রয়েছে! কাতার দু’জনেরই পঞ্চম বিশ্বকাপ। উত্তম বলছেন, ‘‘যে যাই বলুক, এ বার বিশ্বকাপ উঠবে মেসির হাতেই। কারণ, এ বারের আর্জেন্টিনা দলটা অনেক পরিণত। অনেক অভিজ্ঞ।’’
মারাদোনা বিশ্বকাপ জিতেছেন। মেসির এখনও অধরা। উত্তমের দাবি, ‘‘মেসি বিশ্বকাপ জিততে না পারলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে ফুটবলের ইতিহাস!’’ বিশ্বকাপের জন্য বাড়ির সামনে রাস্তার ৪০০ মিটার অংশ জুড়ে তৈরি করেছেন ফ্যান জ়োন। অংশগ্রহণকারী সব দেশের পতাকা জায়গা পেলেও প্রাধান্য সেই নীল-সাদা রঙেরই। তৈরি করা হয়েছে একটি বিশাল আকারের বিশ্বকাপ ট্রফি। ভাল ভাবে খেলা দেখার জন্য জায়ান্ট স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বারই প্রথম নয়, আর্জেন্টিনা বড় কোনও প্রতিযোগিতা খেললেই এমন ব্যবস্থা করে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফ্যান ক্লাব।
কলকাতায় মারাদোনা, মেসিরা যখন এসেছেন তখন পারলে ২৪ ঘণ্টাই যতটা সম্ভব তাঁদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতেন। মারাদোনার কলকাতা সফরের সময় তাঁর বিভিন্ন ভঙ্গির মূর্তি তৈরি করে প্রদর্শনী করেছেন। একটি ৩০ ফুটের মূর্তিও ছিল। সেই মূর্তি দেখতে চেয়েছিলেন মারাদোনা নিজেও। শেষ পর্যন্ত মারাদোনার অবশ্য গাঙ্গুলি বাগানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তা নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে উত্তমের। নিজের বাড়িতে মারাদোনাকে আনতে না পারলেও আর্জেন্টিনায় গিয়ে দেখে এসেছেন তাঁর বাড়ি। মারাদোনার ৫০ বছরের জন্মদিন পালন করেছিলেন ১২০ পাউন্ডের কেক তৈরি করিয়ে। যে কেকের উচ্চতা ছিল মারাদোনার সমান ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি।
মারাদোনা এবং মেসির অন্ধ ভক্ত উত্তম দু’জনের মধ্যে তুলনা করতে রাজি নন। বলেছেন, ‘‘মারাদোনা একজন সম্পূর্ণ ফুটবলার। এক বর্ণময় চরিত্র। দুর্দান্ত নেতা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই জন্ম। প্রতিপক্ষকে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দিতেন না। ব্যক্তিগত ফুটবল দক্ষতায় মেসি সামান্য হলেও এগিয়ে।’’
এ হেন উত্তমই চান একটি ম্যাচে হেরে যাক আর্জেন্টিনা! সেই ম্যাচ আপাতত স্বপ্ন। যদি কখনও কোনও প্রতিযোগিতার নক-আউট পর্বে খেলা হয় আর্জেন্টিনা-ভারতের, সেখান মেসিদের হার চাইবেন। যদি সেই ম্যাচ গ্রুপ পর্বের হয়, তা হলে চাইবেন ড্র।