IPL 2025

চাপের চক্রব্যূহে ঋষভ পন্থ, তাঁর ক্রিকেটজীবনের সঞ্জীবনী হয়ে উঠতে পারে এ বারের আইপিএল

ঋষভ পন্থের ক্রিকেটীয় দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন রয়েছে তাঁর মানসিকতা নিয়ে। আগ্রাসী হতে গিয়ে বহু বার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট ছুড়ে দিয়েছেন। দলকে আরও বিপদে ফেলেছেন।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৫ ০৯:০০
picture of Rishabh Pant

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ছোট্ট একটা ঘুমের ধাক্কার অভিঘাত কতটা হতে পারে আন্দাজ করতে পারেননি ঋষভ পন্থ। তাঁর ক্ষেত্রে অভিঘাতের প্রভাব ত্রিমুখী। শারীরিক, মানসিক এবং ক্রিকেটীয়। শারীরিক এবং মানসিক ভাবে পন্থকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান। ২২ গজে আগের জায়গা ফিরে পেতে পন্থের দরকার পরিমিত আগ্রাসী মানসিকতা। যা তাঁকে দিতে পারে এ বারের আইপিএল।

Advertisement

পন্থের ক্রিকেট প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ নেই কারও। রুরকির তরুণ তিন ধরনের ক্রিকেটেই ভারতীয় দলে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। জাতীয় দলে তিন ধরনের ক্রিকেটে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জায়গাটা পন্থের হাতেই সুরক্ষিত মনে হচ্ছিল একটা সময় পর্যন্ত। কিন্তু চোখ লেগে যাওয়ার জন্য ঘটে যাওয়া একটা দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছে তাঁর ক্রিকেটজীবনের গতিপথ। পন্থ যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চিকিৎসকদের নির্দেশে দিনযাপন করছিলেন, সে সময়ই দেশের মাটিতে হয় এক দিনের বিশ্বকাপ। ভারতীয় দলে পন্থের অভাব ঢাকতে তৎকালীন কোচ রাহুল দ্রাবিড় পরিবর্ত হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন লোকেশ রাহুলকে। আদতে ওপেনিং ব্যাটার রাহুল উইকেট রক্ষাও করতে পারেন। দ্রাবিড়ের ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞাকে বিশ্বকাপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁরই রাজ্যের ব্যাটার।

সাদা বলের ক্রিকেটে বিশেষজ্ঞ ব্যাটারকে দিয়ে উইকেট রক্ষা করানোর ধারণা ভারতীয় দলে নিয়ে এসেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। দ্রাবিড়কে দিয়ে বহু এক দিনের ম্যাচে উইকেট রক্ষা করিয়েছিলেন সৌরভ। এক দিনের ক্রিকেটে দ্রাবিড়ের জায়গা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন থামিয়ে দিয়েছিল সৌরভের রণকৌশল। ভারতীয় দলের কোচ হয়ে দ্রাবিড় ঠিক সেই কৌশলই প্রয়োগ করেন। পন্থের অভাব ঢাকার দায়িত্ব রাহুলকে দেন তিনি। দ্রাবিড়ের দেখানো সেই পথে হেঁটেছেন গৌতম গম্ভীরও। গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও পন্থকে সাজঘরে বসে কাটাতে হয়েছে।

পন্থ দক্ষ উইকেটরক্ষক। আগ্রাসী ব্যাটার। মাঠের সব দিকে শট মারতে পারেন। তাঁর ক্রিকেটীয় দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে প্রশ্ন রয়েছে তাঁর মানসিকতা নিয়ে। আগ্রাসী হতে গিয়ে বহু বার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট ছুড়ে দিয়েছেন। দলকে সমস্যা থেকে রক্ষা করার বদলে আরও বিপদে ফেলে দিয়েছেন। পিচে থিতু হয়ে যাওয়ার পরও শট নির্বাচনে ভুল করেছেন। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছেন বার বার। তবু নিজের ব্যাটিংয়ে পরিবর্তন করেননি। মানসিকতা বদলাননি। কোচ, অধিনায়ক বিরক্ত হয়েছেন। ধমক দিয়েছেন। পন্থ থেকে গিয়েছেন নিজের খেয়ালেই। বল পেলেই উড়িয়ে দেওয়ার দর্শন থেকে নিজেকে বার করে আনতে পারেননি। ধীরে ধীরে আস্থা হারাতে শুরু করেছেন। গত বর্ডার-গাওস্কর ট্রফিতেও তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ের তীব্র সমালোচনা করেছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞেরা। পন্থের মানসিকতায় ক্রমশ গম্ভীর হয়েছে কোচ গৌতমের মুখ। দেশের হয়ে তিন ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ১৫০টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে পন্থের। ভারতীয় দলে তিনি আর নতুন নন। তবু দলের আস্থা হারাচ্ছেন অতিরিক্ত আগ্রাসী মানসিকতার জন্য।

Picture of Rishabh Pant

ঋষভ পন্থ। —ফাইল চিত্র।

ব্যক্তিজীবনে ভারসাম্য রাখতে না পারার মাসুল দিয়েছেন পন্থ। দিল্লি থেকে গাড়ি চালিয়ে রুরকির বাড়ি ফিরতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। জীবনের সেই শিক্ষা এ বার ক্রিকেটেও কাজে লাগাতে হবে পন্থকে। ভারসাম্য আনতে হবে। বুঝতে হবে, আগ্রাসী ক্রিকেট সব সময় প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে না। কখনও কখনও নিজের দলকেও বিপদে ফেলে দেয়। যা প্রত্যাশিত নয়। অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের কাছে আরও বেশি দায়িত্বজ্ঞান প্রত্যাশিত। কোচ, অধিনায়কের আস্থা হারানোয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম একাদশে জায়গা পাননি। নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ে ব্যর্থতায় চাপে থাকা গম্ভীরও ঝুঁকি নিতে চাননি পন্থকে নিয়ে।

ক্রিকেটার পন্থের কাছে এ বারের আইপিএল তাই পরীক্ষা। ক্রিকেটীয় দক্ষতার সঙ্গে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে তাঁকে। এত দিন ভারতীয় দলে খেলার পরও প্রতিভা সদ্ব্যবহারের পরীক্ষা দিতে হবে। পন্থ চাপে থাকবেন নিঃসন্দেহে।

প্রতিযোগিতা শুরুর অনেক আগে পন্থ নিজেই নিজেকে চাপে ফেলে দিয়েছেন আইপিএলের নিলামে নিজের দাম যাচাই করে। তাঁকে ২৭ কোটি টাকা দিয়ে কিনেছে সঞ্জীব গোয়েন্‌কার লখনউ সুপার জায়ান্টস। একাধিক দলের সঙ্গে লড়াই করে তাঁকে দলে নিয়েছিলেন কলকাতার শিল্পপতি। আইপিএলের ইতিহাসে পন্থই এখন সবচেয়ে দামি ক্রিকেটার। তাঁর পিছনে বিপুল বিনিয়োগের সুফল নিশ্চিত ভাবে চাইবেন সঞ্জীব। আপাদমস্তক পেশাদার শিল্পপতির মেজাজ গত মরসুমে টের পেয়েছিলেন রাহুল। মাঠে প্রকাশ্যে ভর্ৎসিত হয়েছিলেন, যা বিস্মিত করেছিল ক্রিকেটমহলকে। বিষয়টি অজানা নয় পন্থের। দলের পারফরম্যান্সের চাপও থাকবে তাঁর উপর। নিজের পারফরম্যান্স, দলের পারফরম্যান্স, উইকেট ছুড়ে না দেওয়া, পরিস্থিতি বুঝে ব্যাটিং এবং অধিনায়ক হিসাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা। পরীক্ষার চক্রব্যূহের মধ্যে পড়ে গিয়েছেন পন্থ। একসঙ্গে গোয়েন্‌কা এবং গম্ভীরের আস্থা অর্জন সহজ নয়।

Picture of KL Rahul and Rishabh Pant

(বাঁ দিকে) লোকেশ রাহুল এবং ঋষভ পন্থ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

এ বারের আইপিএল পন্থের ক্রিকেটজীবনের দিকনির্দেশ করতে পারে। এ বারের আইপিএল তাঁর ক্রিকেটজীবনের সঞ্জীবনী হবে কি না, তা নির্ভর করবে পন্থের উপরই। উইকেটরক্ষক-ব্যাটার হিসাবে আবার ভারতীয় দলে প্রথম পছন্দ হয়ে উঠতে হলে ‘নিজের মতো’ খেলার ধারণা বদলাতে হবে পন্থকে। ‘নিজের মতো’ খেলতে গিয়ে বার বার উইকেট ছুড়ে দিলে পন্থের ক্রিকেট ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হতে পারে। নিজের ক্রিকেটীয় মানসিকতাই পন্থের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতীয় ক্রিকেটে আগ্রাসী উইকেটরক্ষক-ব্যাটারের অভাব নেই। ঈশান কিশন, ধ্রুব জুরেল, জিতেশ শর্মা, সঞ্জু স্যামসন, অভিষেক পোড়েলরা আছেন। দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী চালিয়ে গেলে পন্থের জায়গা কেড়ে নিতে পারেন যে কেউ। সাদা বলের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পন্থের জায়গা টলমলে হয়ে গিয়েছে। লাল বলের ক্রিকেটেও একই পরিস্থিতি হতে সময় লাগবে না।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল ঘোষণার সময় প্রধান নির্বাচক অজিত আগরকর প্রথম উইকেটরক্ষক হিসাবে পন্থের নাম উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পরে কোচ গম্ভীর জানান উইকেটরক্ষক হিসাবে খেলাবেন রাহুলকে। অস্ট্রেলিয়া সফরে পন্থের বেহিসেবি ব্যাটিংয়ে বিরক্ত ছিলেন গম্ভীর। বার বার বুঝিয়েও লাভ হয়নি। লাল বলের ক্রিকেটে অবাধ্যতার প্রভাব চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পড়তে পারে, সম্ভবত বোঝেননি পন্থ। বুঝতে পারার মতো পরিণত এত দিনে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল তাঁর। দলগত খেলায় নিজের মতো খেলার স্বাধীনতা থাকলেও যেমন খুশি খেলার স্বেচ্ছাচারিতা গ্রহণযোগ্য নয়। কোনও খেলোয়াড়ের একগুঁয়ে মানসিকতার খেসারত দিয়ে দিনের পর দিন দলের ক্ষতি মেনে নেওয়া যায় না। দলীয় এই শৃঙ্খলার বাইরে নন পন্থও। প্রতিভা থাকলেই হয় না। একটা সময়ের পর দায়িত্ববোধও প্রয়োজন। গম্ভীরের মতো কড়া ধাঁচের কোচ অন্তত প্রতিভার অপব্যবহার মেনে নেবেন না।

Advertisement
আরও পড়ুন