বেন স্টোকস। ছবি: রয়টার্স।
অ্যাশেজ ২০১৯। তৃতীয় টেস্টে বেন স্টোকসের ১৩৫ রানের অপরাজিত ইনিংস। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড দল ৬৭ রানে অল আউট হয়ে যাওয়ার পরেও যে ম্যাচ জেতা যায় তা বুঝিয়েছিল ইংল্যান্ড। তখনও বাজ়বল (ইংল্যান্ডের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালামের ডাকনাম বাজ়। তাঁর সময়ে ইংল্যান্ড যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলছে সেটার এই নাম দেওয়া হয়েছে।) আসেনি। কিন্তু চোখে চোখ রেখে লড়াই কী ভাবে করতে হয় দেখিয়ে দিয়েছিলেন স্টোকস।
অ্যাশেজ ২০২৩। আরও এক বার লড়লেন সেই স্টোকস। জনি বেয়ারস্টো যখন বেআক্কেলে ছেলের মতো বল কোথায় আছে না দেখে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আউট হলেন, তখনও অধিনায়কোচিত ইনিংস খেললেন ‘বিগ বেন’। স্টোকস রবিবারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এ বার পারলেন না। ১৫৫ রান করেও হল না। প্যাট কামিন্সদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে পারলেন না স্টোকস। লর্ডসে ৪৩ রানে হেরে গেল ইংল্যান্ড।
অ্যাশেজের প্রথম ম্যাচে এজবাস্টনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাজ়বল ব্যর্থ হয়। প্রথম দিনে ৩৯৩ রান তুলে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জো রুট অপরাজিত থাকায় আরও কিছু ক্ষণ ইংল্যান্ড ব্যাট করতে পারে বলে মনে করছিলেন অনেকে। কিন্তু আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ইংল্যান্ড ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেয়। শেষ চার ওভারে অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে নামায়। কাজ হয়নি তাতে। ইংল্যান্ড হেরেও যায় ম্যাচটি।
আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার নামে ইংল্যান্ডের নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল বলে মনে করেন অনেকেই। ইংল্যান্ডের এই বাজ়বল ক্রিকেটের সমালোচনা করেছেন বাংলার ক্রিকেটার তথা রাজ্যের মন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেছেন, ‘‘এ ভাবে খেলে কী হবে? আসল খেলার ফল। আমরা ছোট থেকে শিখেছি আগে নিজেকে বাঁচতে হবে। তার পরে জেতার চেষ্টা করতে হবে। সেখানে পরিস্থিতি বিচার না করে একই পদ্ধতিতে খেলার কোনও মানে হয় না।’’ বাংলার আর এক ক্রিকেটার অনুষ্টুপ মজুমদার আবার মনে করছেন, সাফল্য পাচ্ছে বলেই ইংল্যান্ড বাজ়বল খেলছে। তিনি বলেছেন, ‘‘গত এক বছর ধরে এ ভাবে ক্রিকেট খেলেই ইংল্যান্ড সাফল্য পেয়েছে। তাই ওরা এ ভাবে খেলছে। কিন্তু এত আক্রমণাত্মক খেললে ঝুঁকিও বাড়ে। ওরা টেস্টে একটা নতুন ধারা তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু কত দিন এই ক্রিকেট ওরা খেলতে পারবে সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।’’
মনোজদের কথাই সত্যি হল দ্বিতীয় টেস্টে। ইংল্যান্ডকে সে ভাবে আক্রমণাত্মক হতে দেখা যায়নি। শেষ দিনে স্টোকস কিছুটা আক্রমণাত্মক হয়েছিলেন। কিন্তু সেটাকে বাজ়বল বলা যায় না। বরং অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং সাজানোর মধ্যে ছিল আগ্রাসী পরিকল্পনা। স্টোকস ব্যাট করার সময় ফিল্ডারদের বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন কামিন্স। সেই সঙ্গে চলছিল বাউন্সার করে যাওয়া। একের পর এক শর্ট বল করে গেলেন তাঁরা। স্টোকসকে লোভ দিলেন মারার। দীর্ঘ সময় সেই ভাবে লড়াই চললেও শেষ পর্যন্ত পারল না ইংল্যান্ড।
A gutting end to another sensational Test match...
— England Cricket (@englandcricket) July 2, 2023
Australia lead 2️⃣-0️⃣ in the series.#EnglandCricket | #Ashes pic.twitter.com/doJmO5VWmG
অ্যাশেজে ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে গেল ইংল্যান্ড। সেই অ্যাশেজ যেখান লড়াই শুধু ক্রিকেটের নয়। দুই দলের কথার লড়াইও চলতে থাকে। অ্যাশেজ সিরিজ়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ইতিহাস। যা কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক। খানিকটা শোকেরও। ১৮৮২ সালে ওভালে আয়োজিত টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার কাছে প্রথম হেরেছিল ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার ফ্রেড স্পফোর্থের অনবদ্য বোলিংয়ের কাছে হারতে হয়েছিল ইংরেজদের। চতুর্থ ইনিংসে ৮৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জিততে পারেনি তারা। স্পফোর্থ ৪৪ রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন। ০-১ ব্যবধানে সিরিজ় হেরে গিয়েছিল। পরের দিন ইংল্যান্ডের সংবাদ পত্র ‘দ্য স্পোর্টিং টাইমস্’ তাদের প্রতিবেদনে ক্রিকেট দলের তীব্র সমালোচনা করেছিল। লেখা হয়েছিল, ইংরেজ ক্রিকেটকে চিরস্মরণীয় করে রাখল ওভালের ২৯ আগস্ট, ১৮৮২ তারিখটি। গভীর দুঃখের সাথে বন্ধুরা তা মেনে নিয়েছে। ইংরেজ ক্রিকেটকে ভস্মীভূত করা হয়েছে এবং ছাইগুলো অস্ট্রেলিয়াকে দেওয়া হয়েছে। এর পরের বছর সিরিজ় পুনরুদ্ধার করতে অস্ট্রেলিয়ায় যায় ইংল্যান্ড। সংবাদমাধ্যমের ব্যঙ্গ মনে রেখে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক আইভো ব্লাই বলেছিলেন, তাঁরা অ্যাশেজ পুণরুদ্ধার করতে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছেন।
সে সময় কয়েকজন অস্ট্রেলীয় মহিলা ব্লাইকে আগের সিরিজ়ে পরাজয় নিয়ে পাল্টা ব্যঙ্গ করে ছাই ভর্তি একটি পাত্র দিয়েছিলেন। যাতে ছিল উইকেটের উপরে থাকা বেলের ছাই। তার পর থেকে দু’দেশের টেস্ট সিরিজ় ‘অ্যাশেজ’ বলে পরিচিত হয়। ব্লাই অবশ্য ছাইয়ের সেই আধারটি ব্যক্তিগত উপহার হিসাবে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। বিজয়ী দলকে ট্রফি হিসাবে তা দেওয়া হত না তখন। ব্লাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী লর্ডসে এমসিসি জাদুঘরে সেই পাত্রটি দান করে দিয়েছিলেন।
A hard-fought win 💪
— ICC (@ICC) July 2, 2023
Australia overcome brilliant Ben Stokes to go 2-0 up in the #Ashes ✌#WTC25 | #ENGvAUS 📝: https://t.co/liWqlPCKqn pic.twitter.com/Zc2cyOsrBw
অতীতের সেই যুদ্ধ এখনও তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। তাই ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া লাল বলের ক্রিকেটে একে অপরের মুখোমুখি হলেই পারদ চড়তে থাকে। সেখানে দেখা যায় স্টোকসের হার না মানা জেদ, কামিন্সের ধারাবাহিকতা। জেমস অ্যান্ডারসনের হেলমেটে বল লাগার পরেও লড়াই চালিয়ে যাওয়া, স্টিভ স্মিথের একার হাতে দলকে লড়াইয়ের রান তুলে দেওয়া।
পরের টেস্ট লিডসে। যে মাঠে চার বছর আগে ম্যাচ জেতানো ১৩৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন স্টোকস। ৬ জুলাই থেকে শুরু হবে সেই টেস্ট। স্টোকস ম্যাচ শেষে বলেন, “আমরা বাকি তিনটে টেস্ট জেতার কথাই শুধু ভাবছি। এই সিরিজ় আমরা ৩-২ ব্যবধানে জিততে চাই।”