বিরাট কোহলি। —ফাইল চিত্র।
অভিষেক ম্যাচ খেলতে নেমেছেন স্যাম কনস্টাস। বিপক্ষে তাঁর নায়ক বিরাট কোহলি। ভক্ত কনস্টাস হয়তো ভেবেছিলেন তাঁর নায়কের সামনেই রান করে কেরিয়ারের শুরুটা করবেন। করলেনও। কিন্তু তিনি যেটা ভাবতে পারেননি, তা হল, মাঠে তাঁর নায়কই তাঁর সঙ্গে এমন ব্যবহার করবেন। কনস্টাসের রান করা ছাপিয়ে মেলবোর্নে চর্চার কেন্দ্রে চলে এল বিরাট-ধাক্কা।
হোটেলে ফিরে বিরাট কি মেলবোর্ন টেস্টের প্রথম দিনের রিপ্লে দেখবেন? যদি দেখেন, তা হলে নিশ্চয়ই দশম ওভার শেষে কনস্টাসকে তাঁর ধাক্কা মারা দেখে আক্ষেপ করবেন। বা করবেন না। ১৯ বছরের যে ছেলেটা প্রথম বার দেশের জার্সিতে খেলতে নেমেছে, তাঁকে ম্যাচের শুরুতেই ওই ভাবে আক্রমণ করাটা কতটা উচিত হল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। ইতিমধ্যেই প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা বিরাটের মুণ্ডপাত করতে শুরু করে দিয়েছেন। ৯০ হাজার দর্শকের সামনে বিরাটের ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা মারাটা মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই।
বিরাটের এমন আচরণ যদিও নতুন নয়। ২০১১ সালে তিনি প্রথম বার অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে গিয়েছেন তখন থেকেই। মাইকেল ক্লার্কদের কাছে তিনি ছিলেন, ‘বখে যাওয়া ছেলে’। কিন্তু সেই সময় তাঁর ব্যাট অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের চুপ করিয়ে রাখত। যে কারণে মুখ চললেও তা ব্যাট দিয়ে ঢেকে দিতেন বিরাট। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে চারটি শতরান করেছিলেন তিনি। সেই সময় বিরাট বলেছিলেন, “অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে ভাল লাগে। কারণ ওদের বিরুদ্ধে নিজেকে শান্ত রাখা মুশকিল। মাঠে ঝগড়া করতে আমি পিছপা হই না। আমাকে এগুলো উত্তেজিত করে। নিজের সেরাটা দিতে পারি আমি।”
বিরাট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি চুপ করে থাকার মানুষ নন। ২০১৪ সালে মিচেল জনসন তাঁর দিকে বল ছুড়েছিলেন। বিরাট বলেছিলেন, “আমি জনসনকে বলেছিলাম স্টাম্পে বল করতে। আমার শরীর লক্ষ্য করে বল ছুড়তে বারণ করেছিলাম।” ২০১২ সালে দর্শকদের উদ্দেশে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন বিরাট। ২০১৭ সালে স্টিভ স্মিথ সাজঘরের সাহায্য নিয়েছিলেন একটি রিভিউ নেওয়ার ব্যাপারে। সেই সময় তাঁকে কটূক্তি করেছিলেন বিরাট। আবার সেই স্মিথকে যখন ইংল্যান্ডে সমর্থকেরা ব্যঙ্গ করছিলেন, সেই সময় সমর্থকদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
মাঠে বিরাট সব সময়ই উত্তেজিত। অধিনায়ক থাকাকালীন দলকে যে ভাবে তাতাতেন, দায়িত্ব ছাড়ার পরেও তাঁকে তেমন ভাবেই দেখা যায়। স্লিপে দাঁড়িয়ে কখনও দর্শকদের তাতিয়ে দেন, আবার কখনও স্লেজ করেন ব্যাটারকে। ২০১৮ সালে বিরাট বলেছিলেন, “মানুষ কী ভাববে সেটা ভেবে খেলি না। আমার ইমেজ নিয়ে ভাবি না। আমি খেলি দলকে জেতানোর জন্য।”
সত্যিই তাই। বিরাট নিজের ইমেজের কথা ভাবেন না। বৃহস্পতিবার কনস্টাস যে ভাবে শুরু করেছিলেন, তাতে ভারতীয় দল অনেক বড় সমস্যায় পড়তে পারত। দ্রুত রান তুলছিলেন তিনি। যশপ্রীত বুমরাকে ছক্কা হাঁকাচ্ছিলেন। ভারতীয় বোলারদের উপর চেপে বসছিলেন কনস্টাস। তাঁকে আউট করা সেই সময় খুবই প্রয়োজন ছিল। বিরাট তাই চাইছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ওপেনারের মনঃসংযোগ নষ্ট করতে। যে কারণে ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা মেরে কনস্টাসকে বিরক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি।
কী হয়েছিল বৃহস্পতিবার? মেলবোর্নে তখন দশম ওভার শেষ হয়েছে। মহম্মদ সিরাজ সেই ওভার শেষ করার পর দিক পরিবর্তন করার জন্য হেঁটে আসছিলেন কোহলি। উল্টো দিক থেকে আসছিলেন কনস্টাসও। দু’জনের কাঁধে ধাক্কাধাক্কি হয়। বার বার ধাক্কাধাক্কির ঘটনার রিপ্লে দেখাতে থাকে সম্প্রচারকারী চ্যানেল। সেখানে অবশ্য দেখা গিয়েছে, কনস্টাস মাথা নিচু করে ব্যাট হাতে যাচ্ছিলেন। কোহলিই যাওয়ার পথে দিক পরিবর্তন করে কনস্টাসের কাছে গিয়ে তাঁকে ধাক্কা মারেন।
কনস্টাসের বিষয়টি পছন্দ হয়নি। তিনি কোহলিকে কিছু একটা বলেন। পাল্টা কোহলিও রক্তচক্ষু দেখিয়ে কনস্টাসকে উত্তর দেন। বিষয়টি বেশি দূর গড়ায়নি। সতীর্থ ওপেনার উসমান খোয়াজা এসে কনস্টাসকে সরিয়ে নিয়ে যান। পাশাপাশি কোহলিকেও অনুরোধ করেন ঘটনাটি সেখানে শেষ করে দেওয়ার জন্য। ঝামেলা থামাতে এগিয়ে আসেন আম্পায়ারেরাও।
পরে জলপানের বিরতিতে সম্প্রচারকারী চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেন কনস্টাস। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, “কোহলি আপনার প্রিয় ক্রিকেটার। হঠাৎই মাঠের মাঝে ঝগড়া লাগল। আপনাকে ও ধাক্কা দিল। কী বলেছিল তখন?” কনস্টাস উত্তর দেন, “মনে হয় আমরা দু’জনেই তখন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি ঘটনাটা। নিজের গ্লাভস ঠিক করছিলাম। তার পরেই কাঁধে ধাক্কা খেলাম। তবে এ রকম হতেই পারে। এটাই ক্রিকেট। মাঠের লড়াই মাঠেই থাকুক।”
শাস্তিও পেয়েছেন বিরাট। আইসিসি জানিয়ে দিয়েছে, তাঁর ২০ শতাংশ ম্যাচ ফি কেটে নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তাঁকে একটি ডিমেরিট পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে। ২৪ মাসের মধ্যে আরও তিনটি ডিমেরিট পয়েন্ট পেলে নির্বাসিত হতে হবে বিরাটকে। তিনি জানেন যে সমর্থকেরা তাঁর খেলা দেখতে মাঠে আসেন, তাঁকে নায়কের আসনে বসান, তাঁদের চোখে খারাপ হতে হবে। যে কনস্টাস বিরাটের ভক্ত, তাঁর সঙ্গে এমন ঘটনা হয়তো তরুণ অস্ট্রেলীয়ের মনে ছাপ ফেলে যাবে। যে রবি শাস্ত্রী সব সময় বিরাটের পাশে দাঁড়ান, তিনিও বৃহস্পতিবার বলেন, “ক্রিকেটে বিরাট নিজেকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, একটি দেশকে এত বছর নেতৃত্ব দিয়েছে, তাঁরও কোনও কোনও মুহূর্তে এমন হয়। কিন্তু আমি বলব, এমনটা না হলেই ভাল হত। এমনটা হওয়া অহেতুক। সব কিছুর একটা সীমা থাকে, সেটা অতিক্রম করা উচিত নয়।”
বিরাট সেই সীমাটাই অতিক্রম করে গেলেন? ধারাভাষ্যকার মাইকেল ভন বলছিলেন, কনস্টাসকে উত্তেজিত করার জন্যই এ কাজ করেছেন বিরাট। তিনি এই কাজের তীব্র নিন্দা করেন। বলেন, “বিরাটের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারের এমন কাজ শোভা পায় না।” খুশি হতে পারেননি সুনীল গাওস্করও। বলেন, “দু’জনকেই শাস্তি দেওয়া উচিত।” রিকি পন্টিং বলেন, “কোহলির হাঁটাটা এক বার খেয়াল করুন। সোজা হাঁটতে হাঁটতে ডান দিকে এসে জোর করে ওকে ধাক্কা মারল।”
২০১১ সালে প্রথম বার অস্ট্রেলিয়া যাওয়া বিরাটের বয়স ছিল ২৩ বছর। কনস্টাসের বয়স তখন ছিল ৬ বছর। হয়তো সেই সময় প্রথম বার বিরাটকে দেখেছিলেন। ২০১৪ সালে ব্যাট হাতে জনসনদের যখন শাসন করছেন ভারতীয় ব্যাটার, তখন কনস্টাস হয়তো বেছে নিয়েছেন নিজের নায়ককে। ১৯ বছর বয়সে সেই বিরাটের ধাক্কা খেলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটার। এই আচরণ নায়কোচিত না হলেও বিরাটোচিত তো বটেই। দলকে জেতানোর জন্য যে তিনি নিজের ভাবমূর্তির কথা ভাবেন না।