বিরাট কোহলির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর পার। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শুরুটা হয়েছিল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। রগচটা, বদমেজাজি একটা ছেলে ভারতকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতিয়ে ঢুকে পড়েছিল সিনিয়রদের দলে। শুরুতে সাফল্য আসেনি। দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল। সেই ছেলেটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর কাটিয়ে ফেলল। বলা ভাল, ১৫ বছর রাজত্ব করল। পরিচিত হল ‘কিং কোহলি’ নামে।
২০০৮ সালের ১৮ অগস্ট শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল বিরাট কোহলির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ার। ডাম্বুলাতে সেই ম্যাচে গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে ওপেন করতে নেমেছিলেন বিরাট। সেই গম্ভীর, যাঁর সঙ্গে পরবর্তী সময় জুটি বাঁধা তো দূর, মুখোমুখি হলে মারমুখী হয়ে উঠেছেন দু’জনে। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেই এক দিনের সিরিজ়ে মাত্র একটি অর্ধশতরান করেছিলেন বিরাট। সে ভাবে নজর কাড়তে পারেননি। বরং আউট হয়ে সাজঘরে ফেরার সময় তাঁর বিরক্তি প্রকাশের ধরন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল বিরাটকে। প্রত্যাবর্তন হয়েছিল এক বছর পর। সেটাও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। তার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
বিরাটের প্রথম শতরানও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেই। ইডেনে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে শতরান করেছিলেন বিরাট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেটাই তাঁর প্রথম শতরান। ১৫ বছরে তাঁর ঝুলিতে ৭৬টি শতরান। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি বছর পাঁচটি করে শতরান করেছেন বিরাট। উল্লেখ্য, এর মাঝে আড়াই বছর কোনও শতরান করতে পারেননি তিনি। তার পরেও বিরাট ছুটছেন সচিন তেন্ডুলকরের শত শতরানের রেকর্ড ছুঁতে। ৩৪ বছরের বিরাটের এখনও ২৪টি শতরান প্রয়োজন সেই রেকর্ড ছোঁয়ার জন্য।
১৫ বছরে একাধিক রেকর্ড বিরাটের ঝুলিতে। অভিষেকের পর থেকে সব থেকে বেশি রান (২৫,৫৮২) করেছেন বিরাট। সব থেকে বেশি অর্ধশতরান (১৩১) করেছেন। শতরানের তালিকাতেও (৭৬) এই ১৫ বছরে তিনিই শীর্ষে। ১৫০ রান পার করেছেন ১৬ বার, দ্বিশতরান করেছেন সাত বার। ১৫ বছরে বিরাট ২৫৩৩টি চার মেরেছেন। ৬৩ বার ম্যাচের সেরা হয়েছেন। ২০ বার সিরিজ় সেরা। আইসিসি-র প্রতিযোগিতাতেও বিরাট-পর্বে ধরাছোঁয়ার বাইরে ‘কিং কোহলি’। রান (২৮২০), অর্ধশতরান (২৫), ম্যাচের সেরা (১০) সব কিছুতেই এই ১৫ বছরে শীর্ষে বিরাটই।
সচিনোত্তর পর্বে বিরাট ব্যাট করতে নামলেই শতরানের অপেক্ষায় থাকেন ১৪০ কোটি ভারতবাসী। ২০১১ সালে বিশ্বকাপ জিতে সচিনকে কাঁধে তুলে মাঠ ঘুরেছিলেন বিরাট। বলেছিলেন, “২১ বছর ধরে দেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ঘুরছে সচিনপাজি। আমাদের দায়িত্ব এ বার ওকে কাঁধে তুলে নেওয়া।” সেই কথা শুধু বলার জন্য ছিল না। বিরাট সত্যিই সচিন পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেটের ভরসা হয়ে উঠেছিলেন। বহু কঠিন ম্যাচ একার দায়িত্বে জিতিয়েছেন। রান তাড়া করে জেতা বিরাটের কাছে রোজকার ঘটনা। ‘চেজ় মাস্টার’ নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন তিনি।
১৫ বছরে বিরাট শুধু ভরসার ব্যাটার হয়ে উঠেছেন তাই নয়, ভারতীয় ক্রিকেটে আগ্রাসনের সমার্থক হয়ে উঠেছেন। অধিনায়ক হিসাবেও নজর কেড়েছিল বিরাটের আগ্রাসী মনোভাব। বিরাট অধিনায়ক হওয়ার পর তাঁর রান করার ক্ষমতা যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল। অধিনায়ক হিসাবেও সব থেকে বেশি রানের (১২,৮৮৩) তালিকায় শীর্ষে তিনি (এই ১৫ বছরের মধ্যে)। অধিনায়ক হিসাবে ৪১টি শতরান, ১১টি ১৫০, সাতটি দ্বিশতরান করেছেন। বিরাট অধিনায়ক থাকাকালীন ২৭ বার ম্যাচের সেরা এবং ১২ বার সিরিজ়ের সেরাও হয়েছেন। যদিও বিরাটের নেতৃত্বে ভারত কখনও আইসিসি প্রতিযোগিতা জেতেনি। একাধিক পালকের মুকুটে যে কাঁটা বিরাটকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে সাদা বলের নেতৃত্ব থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। যা হজম করতে পারেননি বিরাট। সাংবাদিক বৈঠকে বোর্ডের বিরুদ্ধেই মুখ খোলেন তিনি। বলে দেন নেতৃত্ব ছাড়ার সময় কেউ তাঁকে বাধা দেয়নি। যদিও তার কিছু দিন আগেই তৎকালীন বোর্ড সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, তিনি নিজে বিরাটকে নেতৃত্ব ছাড়তে বারণ করেছিলেন। ২০২২ সালে লাল বলের ক্রিকেটের অধিনায়কত্বও ছেড়ে দেন বিরাট।
সেই সময় বিরাটের ব্যাটে রান ছিল না। তাই সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে পারেননি। প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা বার বার সমালোচনা করতে শুরু করেন। দল থেকে বাদ দেওয়ার কথাও বলেন অনেকে। একের পর এক সিরিজ় থেকে বিশ্রাম নিতে শুরু করেন বিরাট। তা নিয়েও কথা বলতে ছাড়েননি নিন্দকেরা। সেই সব সমালোচনা উড়িয়ে বিরাট ফিরলেন গত বছর এশিয়া কাপে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শতরান এসেছে তাঁর ব্যাটে।
১৫ বছর পূর্ণ করে ৩৪ বছরের বিরাট শুধুই এগিয়ে চলেছেন। এ বারের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার হতে চলেছেন, যিনি ১২ বছর আগে বিশ্বজয়ী দলেও ছিলেন। তিনি অপেক্ষা করে আছেন আরও এক বার বিশ্বজয়ের স্বাদ পেতে। আর ১৪০ কোটি ভারতবাসী অপেক্ষা করে আছেন তাঁর হাতে আর এক বার বিশ্বকাপ ট্রফি দেখার জন্য।
এক সময় সব ফরম্যাটের ক্রিকেটে ধারাবাহিক ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিলেন বিরাট। অভিমানে ক্রিকেট থেকে বিরতি নিয়ে ফেলেছিলেন। ব্যাট ধরেননি দেড় মাস। ফিরে এসেই রান পেয়ে গিয়েছিলেন বিরাট। মাঠের বাইরে থাকার সময়টা যে কঠিন ছিল, সেটা স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় পরিবার ছাড়া একমাত্র মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে পাশে পেয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন বিরাট। আইসিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিরাট বলেছিলেন, “ওই সময়ে আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল আমার স্ত্রী অনুষ্কা। গোটা সময়টাই আমার সঙ্গে কাটিয়েছিল এবং চোখের সামনে দেখেছিল প্রতিটা অনুভূতি। কোন অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমি গিয়েছিলাম, কী কী আমার সঙ্গে হয়েছিল। আর একটা কথা বলতেই হবে— ছোটবেলার কোচ এবং পরিবার ছাড়া যে মানুষটা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল, সে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।”
টানা ১১ বছর ভারতের সাজঘরে ধোনির সঙ্গে ছিলেন বিরাট। ভারতের সেরা অধিনায়ক হিসাবে ধোনিকে মেনে নিতেও কোনও দ্বিধা নেই তাঁর মনে। বলেছেন, “ধোনির সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করা যায় না। ও নিজে থেকে আমাকে ফোন করেছে। যে কোনও দিন ফোন করলে ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত থাকতে পারেন যে ধোনি ফোন ধরবে না। কারণ ও ফোনের দিকেই তাকায় না। সে কিনা দু’বার আমাকে নিজে থেকে মেসেজ করেছে। ও আমাকে বলেছিল, ‘তোমাকে শক্তিশালী হতে হবে। নিজেকে এতটা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে লোকে এটা না জিজ্ঞাসা করে যে তুমি কেন আছ?’ ধোনির ওই কথা আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। কারণ আমি নিজেকে এত দিন আত্মবিশ্বাসী, মানসিক ভাবে শক্তিশালী মানুষ হিসেবেই দেখতাম, যে কিনা যে কোনও পরিস্থিতিতে সমাধানের একটা পথ খুঁজে পায়।”
সেই কঠিন সময় এখন অতীত। বিরাট আবার ফর্মে ফিরেছেন। তাঁর ব্যাট কথা বলছে। চুপ করে গিয়েছেন নির্বাচকেরা।