BGT 2024-25

গাওস্করের পায়ে পড়লেন নীতীশের পিতা, চোখের জলে মুতিয়ালাকে জড়িয়ে ধরলেন সুনীল

মেলবোর্নে দেখা গেল এক সুন্দর দৃশ্য। সুনীল গাওস্করকে দেখতে পেয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন নীতীশ রেড্ডির পিতা। আবেগ ধরে রাখতে পারেননি গাওস্করও। তিনি জড়িয়ে ধরেন মুতিয়ালা রেড্ডিকে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:১৯
cricket

(বাঁ দিকে) গাওস্করের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে মুতিয়ালা। গাওস্করের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম নীতীশ রেড্ডির পিতার (ডান দিকে)। ছবি: ভিডিয়ো থেকে।

পুত্রের শতরানের পর ক্যামেরা তাক করেছিল পিতার দিকে। গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন মুতিয়ালা রেড্ডি। হাতজোড় করে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন ঈশ্বরকে। সেই দৃশ্য দেখে ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি সুনীল গাওস্কর। সেই আবেগের বাঁধ আরও এক বার ভাঙল। মেলবোর্নে পঞ্চম দিন গাওস্করের সঙ্গে দেখা হল নীতীশ রেড্ডির পিতার। সঙ্গে ছিলেন পরিবারের বাকিরাও। সেখানে দেখা গেল এক সুন্দর দৃশ্য।

Advertisement

গাওস্করকে দেখতে পেয়েই তাঁর পায়ে পড়ে যান মুতিয়ালা। গাওস্কর অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে বাধা দিতে পারেননি। তার পরেই মুতিয়ালাকে জড়িয়ে ধরেন গাওস্কর। দেখা যায়, তাঁর চোখে জল। নীতীশের এই সাফল্যের কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন মুতিয়ালাকে। গাওস্কর বলেন, “আমরা জানি আপনি কত ত্যাগ করেছেন। কত পরিশ্রম করেছেন। আপনার জন্য আমরা একটা হিরে পেয়েছি। আপনার জন্য ভারতীয় ক্রিকেট একটা হিরে পেয়েছে। সেই জন্যই আপনাকে দেখে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না।” পরিবারের বাকিদের সঙ্গেও কথা বলেন গাওস্কর। সকলের সঙ্গে ছবি তোলেন তিনি। পরে রবি শাস্ত্রীর সঙ্গেও দেখা হয় নীতীশের পরিবারের।

নীতীশের যখন ১২ বছর বয়স তখন তাঁকে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার তথা প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক এমএসকে প্রসাদের কাছে নিয়ে যান মুতিয়ালা। নীতীশকে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন প্রসাদ। নেটে তাঁর ব্যাটিং-বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার। তখনই অন্ধ্রপ্রদেশ ক্রিকেট সংস্থার সঙ্গে কথা বলেন প্রসাদ। সংস্থা ঠিক করে, প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা খরচ করা হবে নীতীশের পিছনে। তাঁর খেলাধুলো ও পড়াশোনার জন্য সেই টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। সেই ১৫ হাজার টাকাই তাঁর কেরিয়ার বদলে দিয়েছিল।

ভারতীয় ক্রিকেটে নীতীশের এই উত্থানের নেপথ্যে তাই অন্ধ্রপ্রদেশ ক্রিকেট সংস্থার অবদান অস্বীকার করা যায় না। সেই কাহিনি শুনিয়েছেন প্রসাদ। তিনি বলেন, “নীতীশের সাফল্যের নেপথ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ ক্রিকেট সংস্থার অনেক অবদান রয়েছে। প্রথম বার ওকে দেখেই বুঝেছিলাম, ওর মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশ ক্রিকেট সংস্থা ঠিক করেছিল, একটা সময় পর্যন্ত প্রতি মাসে ওর জন্য ১৫ হাজার টাকা খরচ করবে। সেই সাহায্য পেয়েছিল বলেই ও এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে। ওর সাফল্যে আমি খুব খুশি।”

তবে যে সাহায্য তিনি পেয়েছেন তা কাজে লাগিয়েছেন। পরিশ্রম করেছেন। সেই পরিশ্রম কাছ থেকে দেখেছিলেন প্রসাদ। তিনি বলেন, “নীতীশ কোনও দিন ফাঁকি দেয়নি। প্রতি দিন কঠিন পরিশ্রম করত। ওর একটাই স্বপ্ন ছিল। ভারতীয় দলে খেলতে হবে। নীরবে নিজের কাজটা করে দিয়েছে। ও ক্রিকেট ভালবাসে। সেই ভালবাসা ওকে সম্মান এনে দিয়েছে। ওর পরিবার যে ত্যাগ করেছে, তার পুরস্কার ওরা এক দিনে পেয়েছে।”

গত বার আইপিএলে ভাল খেলায় এ বার তাঁকে নিতে আগ্রহ দেখিয়েছিল অনেক দল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৬ কোটি টাকায় তাঁকে ধরে রাখে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। নিজের রাজ্যের দলের হয়েই খেলবেন বলে ঠিক করেছিলেন নীতীশ। ১৫ কোটির লোভও ছাড়েন তিনি। পুত্রের ইনিংসের পর সে কথা জানিয়েছেন মুতিয়ালা। তিনি বলেন, “আইপিএলের একাধিক দল নীতীশকে পেতে চেয়েছিল। ১৫ কোটির বেশি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আমাদের। নীতীশের মতামত চেয়েছিলাম। ও প্রশ্ন করেছিল, ‘এত দিন কারা আমাদের পাশে ছিল? কাদের হয়ে খেলে প্রচার পেয়েছি?’ হায়দরাবাদের কথা বলতেই নীতীশ আমাকে বলে, ‘তা হলে কেন দল ছাড়ব? বেশি টাকার জন্য দল বদলালে নিজেকে আবার প্রমাণ করতে হবে। ব্যর্থ হলে তারা বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু হায়দরাবাদের হয়ে দুটো ম্যাচ খারাপ খেললেও দল পাশে থাকে। খেলার সুযোগ দেয়।’ নীতীশের ভাবনাটা খারাপ লাগেনি। তাই টাকার পিছনে না ছুটে নিলামের আগে হায়দরাবাদের সঙ্গে চুক্তি করে নেওয়ায় মত দিয়েছিলাম।’’

অথচ ছোটবেলায় ক্রিকেটার নন, অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন নীতীশ। কিন্তু তাঁর পিতা চাইতেন পুত্র হোক ক্রিকেটার। দেশের হয়ে খেলেও নায়কসুলভ জীবনযাপন করা যায়, সেটাই পুত্রকে বুঝিয়ে ছিলেন তিনি। পিতার দেখানো সেই পথে হেঁটেই ভারতীয় টেস্ট দলের প্রথম একাদশে জায়গা করে নেন নীতীশ। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তরুণ ক্রিকেটার বলেন, ‘‘সত্যি বলতে ছোটবেলায় ক্রিকেট খুব একটা ভাল লাগত না। তবু আমার ভবিষ্যতের জন্য বাবা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার জন্য প্রচুর কষ্ট করেছেন বাবা। এক দিন দেখি বাবা কাঁদছেন। তখন আমাদের প্রবল আর্থিক সমস্যা। সে সময় সব কিছুই অনিশ্চিত মনে হত। কিন্তু কষ্টের মধ্যেও বাবা সব সময় আশা দেখতেন। তখন থেকে মন দিয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করি। ভারতীয় দলের প্রথম জার্সিটা বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সে দিন বাবা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।’’

ছ’বছর বয়সে ক্রিকেট শেখা শুরু ২১ বছরের অলরাউন্ডারের। মুতিয়ালা পুত্রকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কুমার স্বামীর অ্যাকাডেমিতে। তাঁর প্রশিক্ষণেই ক্রিকেটার হয়ে উঠেছেন নীতীশ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ছাত্রের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত নীতীশের ছোটবেলার কোচ কুমার। তিনিও মানছেন নীতীশের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান মুতিয়ালারই। পুত্রকে সময় দেওয়ার জন্য, তাঁর স্বপ্ন সফল করার জন্য সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন মুতিয়ালা। থেকেছেন ভাড়াবাড়িতে। প্রতি দিন ৩০ কিলোমিটার পুত্রকে নিয়ে যাতায়াত করেছেন। শনিবার মেলবোর্নের গ্যালারিতে বসে কাঁদতে কাঁদতে পুত্রের তারকা হওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন মুতিয়ালা।

সেই কারণেই হয়তো টেস্টে নিজের প্রথম শতরান পিতাকেই উৎসর্গ করেছেন নীতীশ। শনিবার দিনের খেলা শেষের পর নীতীশ সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করেন। সেখানে গ্যালারিতে বসে তাঁর পিতার কান্নার ছবি রয়েছে। নীতীশ লেখেন, “এই শতরান তোমার জন্য বাবা।” নীতীশের ক্রিকেট খেলার নেপথ্যে মুতিয়ালার অবদান কম নয়। নীতীশের স্বপ্নকে সত্যি করার চেষ্টায় লেগে পড়েছিলেন মুতিয়ালা। বহু রাতে ঘুম হয়নি, খাওয়া হয়নি। অনেক আত্মত্যাগের ফসল শনিবার নীতীশের শতরান। যে স্বপ্নের জন্য ১৫ কোটির লোভ ছেড়েছেন, সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে সফল হচ্ছে। এ ভাবেই তো তারকার জন্ম হয়। শনিবারের মেলবোর্ন সেটাই দেখেছে।

Advertisement
আরও পড়ুন