যশপ্রীত বুমরা। —ফাইল চিত্র।
হতাশা ১
এক দিনের বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি উইকেট নেওয়া মহম্মদ শামি বাড়িতে ভাইঝির সঙ্গে খেলছেন। ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারছেন না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে যে তিনি সুস্থ হবেন না, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সচিব জয় শাহ।
হতাশা ২
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে এ বারের আইপিএলে মহম্মদ সিরাজ সাত ম্যাচে ২৬৯ রান দিয়ে নিয়েছেন মাত্র ৫ উইকেট। সব ক্রিকেট সমালোচকদের মতে বেঙ্গালুরুর বোলিং চোখে দেখা যাচ্ছে না। যে কোনও দল যে কোনও মাঠে সিরাজদের বিরুদ্ধে ২০ ওভারে ২০০ রান করে দিচ্ছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সিরাজকে নিয়ে গেলেও নিশ্চিন্তে তাঁর হাতে বল তুলে দিতে পারবেন তো রোহিত শর্মা?
হতাশা ৩
সাধারণত ভারতীয় দলে সম্প্রতি চতুর্থ পেসারের জায়গা পাচ্ছেন প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, মুকেশ কুমার, আরশদীপ সিংহ, আবেশ খান এবং আকাশ দীপের মধ্যে কোনও এক জন। কিন্তু প্রসিদ্ধের চোট। মুকেশ এ বারের আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে ৬ ম্যাচে ২২৩ রান দিয়েছেন। ওভার প্রতি রান ১০.৩৭। তাঁকে নিয়ে আশার কথা একটাই। তাঁর নামের পাশে থাকা ১০ উইকেট। পঞ্জাব কিংসের হয়ে আরশদীপ আট ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়েছেন। তিনি দিয়েছেন ২৫৭ রান। ওভার প্রতি তিনি ৯.৪০ রান দিয়েছেন। আবেশ খেলেন রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে। ৮ ম্যাচে তিনি দিয়েছেন ২৯২ রান। নিয়েছেন ৮ উইকেট। আকাশ এখনও পর্যন্ত একটি ম্যাচই খেলেছেন। সেই ম্যাচে ৫৫ রান দিয়ে একটি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ভারতীয় পেস আক্রমণের এই হতাশাজনক তিন চিত্র নির্বাচকদের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক নয়। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো বিশ্বকাপের জন্য ভারতের ১৫ জনের দল ঘোষণা করে দেওয়া হবে। আইসিসি-র নিয়ম অনুযায়ী ১ মে-র মধ্যে দল ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু যশপ্রীত বুমরা ছাড়া এই মুহূর্তে ভারতীয় দলে এমন কোনও পেসার নেই, যিনি রোহিতকে নিশ্চিন্ত করতে পারেন। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে যখনই বল হাতে নিয়েছেন বুমরা, তখনই উইকেট এনে দিয়েছেন। ৮ ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়ে বেগনি টুপির মালিক এখন তিনিই। দিয়েছেন ২০৪ রান। ওভার প্রতি ৬.৩৮ রান দিয়েছেন। বাকি ভারতীয় বোলারদের সঙ্গে তাঁর তফাত যে কত বেশি তা বার বার দেখিয়ে দিচ্ছেন বুমরা। চোট সারিয়ে ফিরে এসে তিনি নিজেকে প্রতি দিন আরও নিখুঁত করে তুলছেন। কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁর সঙ্গী কে হবেন?
ছ’মাস আগেও ভারতীয় পেস বোলিংয়ের ছবিটা এমন ছিল না। ঘরের মাঠে এক দিনের বিশ্বকাপে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন ভারতীয় পেসারেরাই। কিন্তু শামির চোট আর সিরাজের ফর্ম হারানো পুরো পরিস্থিতিটাই পাল্টে দিয়েছে। বরং অজিত আগরকরের নির্বাচন কমিটি নিশ্চিন্ত থাকবে স্পিন বিভাগ নিয়ে। সেখানে রবীন্দ্র জাডেজা এবং কুলদীপ যাদবের জায়গা পাকা। আলোচনা হতে পারে রবি বিষ্ণোই এবং যুজবেন্দ্র চহালের মধ্যে কাকে নিয়ে যাওয়া হবে তা নিয়ে।
এই মুহূর্তে যদি কেউ বলেন ভারতে পেসারের অভাব রয়েছে, তাহলে অবশ্যই তাঁর দিকে চোখ কুঁচকে তাকাবেন ক্রিকেট সমর্থকেরা। কিন্তু তাঁদের যদি প্রশ্ন করা হয় বুমরার সঙ্গে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোন পেসার নতুন বল হাতে নেবেন, তা হলে চট করে উত্তর দেওয়া কঠিন হবে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এক সময় নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন ভুবনেশ্বর কুমার। তিনি এখন আলোচনার বাইরে। ভারতের পেস আক্রমণ সাজানোই হয় তিন জনকে দিয়ে। বুমরা-শামি-সিরাজের ত্রিভুজ আক্রমণ এক দিনের বিশ্বকাপে বিপক্ষের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেই আক্রমণ বিভাগকে দেখা যাবে না। বুমরার সঙ্গে হয়তো সিরাজ যাবেন আমেরিকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে। সেই সঙ্গে যেতে পারেন আরশদীপ। কিন্তু অধিনায়ক নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন তো এই আক্রমণ নিয়ে?
ভারতে পেসারের অভাব নেই। কিন্তু বিশ্বকাপে প্রয়োজন অভিজ্ঞতা। অনভিজ্ঞ উমরান মালিক, মায়াঙ্ক যাদবদের উপর ভরসা রাখা যাবে না। উমরান আইপিএল মাতিয়ে দিয়েছিলেন গতি দিয়ে। দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টিও খেলেছেন। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, বোঝা গিয়েছে উমরানের গতি আছে এবং শুধু গতিই আছে। লাইন এবং লেংথ গুলিয়ে ফেলেন তিনি। প্রথম বলে ব্যাটার ছক্কা মারলে উমরান পরের বল ইয়র্কার বা বাউন্সার দিয়ে ব্যাটারকে পাল্টা আক্রমণ করতে পারেন না। বরং তিনি হয়তো পরের বলটি ওয়াইড করে ফেলেন। তাতে দলের চাপ বেড়ে যায়। সানরাইজার্স হায়দরাবাদ এ বারের আইপিএলে একটি ম্যাচে তাঁকে খেলিয়েছিল। সেই ম্যাচেও এক ওভারে ১৫ রান দেওয়ার পর আর তাঁকে দিয়ে বল করায়নি। এমন বোলারকে যে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া হবে না, তা এখনই বলে দেওয়া যায়।
এ বারের আইপিএলে গতি দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মায়াঙ্ক। লখনউ সুপার জায়ান্টসের এই পেসার আইপিএলে প্রথম দু’টি ম্যাচেই সেরা হয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত তিনটি ম্যাচ খেলে ৬ উইকেট নিয়েছেন মায়াঙ্ক। তাঁর সব থেকে বড় গুণ তিনি শুধু ১৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে বল করেন না। লাইন এবং লেংথও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ফলে মায়াঙ্ককে সামলানো কঠিন হয় ব্যাটারদের পক্ষে। কিন্তু তিনি দেশের হয়ে এখনও একটিও ম্যাচ খেলেননি। সরাসরি বিশ্বকাপে তাঁর অভিষেক হওয়া কঠিন। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ়ে মায়াঙ্ককে আগে খেলাতে চাইবেন নির্বাচকেরা। সেক্ষেত্রে পরের বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের জন্য তাঁকে ভাবা যেতে পারে। এখনই দেশের জার্সি পরা তাঁর পক্ষে কঠিন। দু’টি ম্যাচ খেলেই চোট পেয়ে যান তিনি। ফলে পুরো আইপিএল খেলাও সম্ভব হল না তাঁর। তাই আইপিএলে দু’টি ম্যাচে ভাল খেলা এক জন পেসারকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নামানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া নির্বাচকদের পক্ষেও সহজ নয়।
বিশ্বকাপের ১৫ জনের দলে বুমরার সঙ্গী হিসাবে পেস বিভাগে কাদের নাম থাকবে তা নিয়ে আলোচনা হবে। চমক হতে পারেন দীপক চাহার। চেন্নাই সুপার কিংসের এই পেসার পরীক্ষিত। ভারতের হয়ে খেলেছেন কিন্তু তাঁর সমস্যা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারা। চাহার ৬ ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়েছেন। ওভার প্রতি তিনি দেন ৮.৭৩ রান। ডেথ ওভারে বল করার অভিজ্ঞতা আছে।
ছ’মাস আগে যা ছিল সম্পদ সেই ভারতীয় পেস আক্রমণই এখন কিছুটা খেই হারিয়েছে। শামির চোট পাওয়া বড় ধাক্কা নির্বাচকদের কাছে। সেই সঙ্গে সিরাজের ফর্ম হারানো। সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বোলিং আক্রমণ সামলানোর ক্ষেত্রে অস্ত্র হয়তো স্পিনারেরাই। সেই সঙ্গে একা কুম্ভ বুমরা তো রয়েছেনই।